খেলাপি প্রতিষ্ঠানকেই ফের ঋণ দিচ্ছে জনতা ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রবর্তন | প্রকাশিতঃ ১০:৫১, ০৬ নভেম্বর ২০১৯

কোনো ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানকে নতুন ঋণ দিতে পারে না ব্যাংক। তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানার জনতা ব্যাংকে ওই অনিয়ম ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন বা বিএসএফআইসি। ওই সংস্থার চেয়ারম্যান জনতা ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুবাদে প্রভাব খাটিয়ে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল এবং নতুন ঋণ অনুমোদনের ব্যবস্থা করেছেন। এসব অনিয়মের কারণে জনতা ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

জানা গেছে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর জনতা ব্যাংকের পর্ষদ বৈঠকে বিএসএফআইসির ৭৮৯ কোটি ৮২ লাখ টাকার ঋণ পুনঃতফসিল ও ২৪৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার নতুন ঋণ প্রস্তাব ওঠে। এই প্রস্তাব বৈঠকের এজেন্ডায় ছিল না। এজেন্ডা-বহির্ভূতভাবে এত বড় প্রস্তাব উত্থাপনের বিরোধিতা করেন বৈঠকে উপস্থিত একাধিক পরিচালক। যাচাই-বাছাই শেষে পরবর্তী সভায় তা উত্থাপনের অনুরোধ জানান তারা। তা সত্ত্বেও সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান অজিত কুমার পালের চাপে শর্তসাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। আইন অনুযায়ী স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবে অজিত কুমার পালের নিশ্চুপ থাকার কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী পর্ষদ বৈঠকে যে কোনো প্রস্তাব আগে থেকেই এজেন্ডাভুক্ত করে অন্তত তিন দিন আগে পরিচালকদের জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইন ও নির্দেশনা দুটিই লঙ্ঘন করা হয়েছে। আর অন্য ব্যাংকে খেলাপি থাকলেও পুনঃতফসিল ও নতুন ঋণ অনুমোদনেও আইন মানা হয়নি। জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জামালউদ্দিন আহমেদ এফসিএ বলেন, বিএসএফআইসি সরকারি সংস্থা। জনতা ব্যাংকের মালিক সরকার। এ ছাড়া সার, খাদ্যসহ সরকারের অগ্রাধিকার কিছু ক্ষেত্রে অনেক সময় ঋণ প্রস্তাবের অনুমোদন দিতে হয়। পর্ষদের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠানো হয়েছে। অনাপত্তি পেলে এরপর ঋণ পুনঃতফসিল ও নতুন ঋণ অনুমোদন কার্যকর হবে।

জতীয় সংসদে সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশের শীর্ষ ৩০০ খেলাপির তালিকায় ৩০ নম্বরে রয়েছে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। সেখানে বিভিন্ন ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি দেখানো হয়েছে ৩৫২ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাখ্যা তলবের চিঠিতে তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি উল্লেখ করা হয়েছে ৪০৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ছয় বছরে প্রতিষ্ঠানটি নিট চার হাজার ৬৭ কোটি টাকা লোকসান করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, অজিত কুমার পাল ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৮ ধারা লঙ্ঘন করে প্রভাব খাটিয়ে ঋণ অনুমোদন করিয়েছেন। ধারাটি ব্যাংকের পরিচালক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের লেনদেনের বিধান সম্পর্কিত। এই ধারায় বলা আছে, কোনো পরিচালকের স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিষয়ে পর্ষদ বৈঠকে আলোচনা উঠলে সভার শুরুতেই তিনি পর্ষদকে বিষয়টি অবহিত করবেন। এরপর আলোচনায় অংশগ্রহণ বা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। এ ছাড়া তার উপস্থিতি ওই সভার কোরামের জন্য গণ্য করা যাবে না। চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান হওয়া সত্ত্বেও ওই ঋণ প্রস্তাব উপস্থাপনের সময় উপস্থিত থেকে তা অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছেন, যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে উত্থাপনের আগে যে কোনো বিষয় এজেন্ডাভুক্ত করার জন্য ২০১৮ সালের এক সার্কুলারের মাধ্যমে নির্দেশনা দেওয়া হয়। চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের ৭৮৯ কোটি ৮২ লাখ টাকার ঋণ পুনঃতফসিল এবং বিদ্যমান ঋণসীমা ৫৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব আগে থেকে এজেন্ডাভুক্ত না করে তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সার্কুলারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, সিআইবি প্রতিবেদন অনুযায়ী চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বিভিন্ন ব্যাংকে তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা দায় রয়েছে। এর মধ্যে ৪০৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা খেলাপি। খেলাপি ঋণ থাকার পরও নতুন করে ২৪৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণসীমা অনুমোদন ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৭ক(৩) ধারার লঙ্ঘন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান অজিত কুমার পাল এফসিএ টেলিফোনে  বলেন, ‘এটি সরকারি করপোরেশন। আমি আজ আছি কাল নেই। যে কোনো সময় আরেক জায়গায় হয়তো আমার পদায়ন হয়ে যাবে। এখানে প্রভাব খাটানোর কিছু নেই।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এভাবে চিঠি না দিলেও পারত। পরিচালক থাকলে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। শুধু ভোট দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। তাছাড়া ব্যাংকের ১০ পরিচালকের মধ্যে একজন কীভাবে প্রভাব খাটাতে পারে? জনতা ব্যাংকের পর্ষদ থেকে চাওয়া ব্যাখ্যার জবাব দিয়েছেন বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘সাময়িক সংকট মেটাতে ঋণ নিতে হচ্ছে। এ সময়ে চাষিদের টাকা দিতে হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হবে। সরকার যেহেতু নগদ টাকা দিচ্ছে না, এ কারণে ঋণ নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে টাকা পেলে আবার সমন্বয় করা হবে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে এজেন্ডা-বহির্ভূত অনেক ঋণ অনুমোদনের ফলে বড় অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই ইস্যুতে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই সার্কুলারে বলা হয়, ব্যাংকের পর্ষদ সভায় এজেন্ডা-বহির্ভূত বিষয় উত্থাপিত হলে পর্ষদের সব সদস্য আগ থেকে অবহিত থাকার সুযোগ পান না। এতে ওই বিষয়ের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে পরিচালকরা মতামত দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। এ ছাড়া পর্ষদে প্রস্তাব উপস্থাপনের আগে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃক প্রস্তাবটির বিভিন্ন দিক বিচার-বিশ্নেষণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে সে সুযোগও থাকে না। তাই এজেন্ডা-বহির্ভূত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে ব্যাংক ও আমানতকারীর স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে এজেন্ডা-বহির্ভূত কোনো বিষয় পর্ষদ কর্তৃক বিবেচনা না করার পরামর্শ দেওয়া হয় ওই নির্দেশনায়।

আরেক খেলাপিকে ঋণ দেওয়ার চেষ্টা :জাতীয় সংসদে প্রকাশিত শীর্ষ খেলাপির তালিকায় নাম রয়েছে রাজ্জাকুল হোসেনের মালিকানাধীন রুট গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের নাম। রানকা সোহেল কম্পোজিট, রানকা ডেনিম টেক্সটাইল মিলস ও গ্রাম বাংলা এনপিকে ফার্টিলাইজার অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা এক হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ২২ কোটি টাকাই খেলাপি। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শনে উঠে আসে, রানকা সোহেল কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার করেছে। এত সব অভিযোগের পরও প্রতিষ্ঠানটিকে নানা সুবিধা দেওয়ার জন্য মরিয়া জনতা ব্যাংক। অর্থ পাচারের বিষয়টি সুরাহা ছাড়াই নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। অবশ্য গ্রাম বাংলা এনপিকে ফার্টিলাইজারকে এলসির মাধ্যমে আরও ৭৫১ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেওয়ার তোড়জোড় ছিল।

জনতা ব্যাংকে যত অনিয়ম : সম্প্রতি বড় বড় অনিয়মের কারণে আর্থিক খাতে এখন আলোচিত নাম জনতা ব্যাংক। ক্রিসেন্ট, অ্যাননটেক্স, বিসমিল্লাহসহ কয়েকটি গ্রুপের জালিয়াতির কারণে চরম দুরবস্থায় পড়েছে ব্যাংকটি। ভুয়া রপ্তানি বিলের বিপরীতে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ, একক গ্রাহকের ঋণসীমা অতিক্রমসহ নানা অনিয়ম করে এসব প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ১০ হাজার ৩১২ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে অ্যাননটেক্সের খেলাপি ঋণ ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকা। ক্রিসেন্ট গ্রুপের তিন হাজার ৫৭২ কোটি টাকা এবং বিসমিল্লাহ গ্রুপের খেলাপি রয়েছে ৫৪০ কোটি টাকা। এসব কারণে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ এখন জনতায়। গত জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে তিন হাজার ৭৪ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতি রয়েছে আরও এক হাজার ২০১ কোটি টাকা।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top