মূল্য কম দেখিয়ে জমি রেজিস্ট্রি, লাপাত্তা সাবরেজিস্ট্রার

নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রবর্তন | প্রকাশিতঃ ২২:৪২, ০১ নভেম্বর ২০১৯

দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে এখন লাপাত্তা গাজীপুর সদরের সাবরেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম। বিশেষ করে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে বিপুল পরিমাণ জমি রেজিস্ট্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

১০ অক্টোবর তাকে নিয়ে হাইকোর্টের একটি নির্দেশনার পর সম্ভাব্য পরিণতি আঁচ করতে পেরে তখন থেকেই তিনি অফিসে অনুপস্থিত। হাইকোর্টের ওই নির্দেশের পর অস্ট্রেলিয়ায় প্রশিক্ষণে যাওয়ার জন্য মঞ্জুর হওয়া দুই বছরের ছুটিও বাতিল করে দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। তার সন্তান ও স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরেই ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন।

অনেকের ধারণা, হাইকোর্টের নির্দেশের পরপরই মনিরুল ইংল্যান্ডে পালিয়ে গেছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, মনিরুল দেশেই আত্মগোপন করে আছেন।

গাজীপুর সদর সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের দলিল লেখক আফসার উদ্দিন জমির মূল্য কম দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে বহু জমি রেজিস্ট্রি করায় মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। পরে বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ অভিযোগটি ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত করে দেখার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন।

একইসঙ্গে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর সাবরেজিস্ট্রার মনিরুলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ারও নির্দেশ দেন। এরপর থেকেই মনিরুল গাঢাকা দেন।

সূত্র জানায়, মনিরুল ইসলাম নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে জমির রেজিস্ট্রি করে নিজে লাভবান হলেও সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

কথা হয় নিবন্ধন অধিদফতরের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সাবরেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামকে নিয়ে হাইকোর্টের আদেশের পর আইন মন্ত্রণালয় তার অস্ট্রেলিয়া সফর বাতিল করেছেন। প্রশিক্ষণের জন্য তার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিল।

মনিরুল এখন কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, মনিরুল বর্তমানে দেশে নেই। শুনেছি হাইকোর্টের আদেশের পর তিনি ইংল্যান্ডে চলে গেছেন। সেখানে তার স্ত্রী ও সন্তান বসবাস করছেন। মনিরুলের বিরুদ্ধে তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে শুনেছি। এখনও লিখিত কিছু পাইনি।

কথা হয় আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আনোয়ারুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, মনিরুল ঠিক কোথায় আছেন তা বলতে পারব না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মনিরুলের স্থলে ভারপ্রাপ্ত সাবরেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করছেন খন্দকার গোলাম কবির। জানতে চাইলে তিনি বলেন, মনিরুল কোথায় তা আমি বলতে পারব না। তবে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ১৬ অক্টোবর থেকে আমি ভারপ্রাপ্ত সাবরেজিস্ট্রার হিসেবে এখানে দায়িত্ব পালন করছি। তবে তিনি ছুটিতে আছেন কিনা তা আমি বলতে পারব না। অবস্থান জানতে মনিরুলকে একাধিক বার ফোন দেয়া হলেও তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

মনিরুল ইসলামের ব্যাপারে জানতে গাজীপুর জেলা রেজিস্ট্রার মুন্সী মুখলেছুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

রিট আবেদনকারী আফসার উদ্দিন জানান, আমার ধারণা হাইকোর্টের আদেশের পরই গোপনে তিনি ইংল্যান্ড পাড়ি জমিয়েছেন। তিনি যদি সত্যিই দেশের বাইরে চলে যান তাহলে তিনি হয়তো আর দেশে ফিরবেন না। আগস্টে আইন পড়ার কথা বলে একবার লন্ডনে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

আইন মন্ত্রণালয় দুই বছরের জন্য (২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর) ছুটিও মঞ্জুর করেছিল। তিনি বলেন, ২৭ জুলাই দুদক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, আইন মন্ত্রণালয়, নিবন্ধন অধিদফতর, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও গাজীপুরের ডিসি-এসপির কাছে লিখিতভাবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়। আবেদনে ৩৯টি দলিলের নম্বর উল্লেখ করে বলা হয়, এসব দলিলসহ আরও অসংখ্য দলিলে জমির মূল্য কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে। সেখানে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমাণ দেয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

গাজীপুর সিটির গোবিন্দবাড়ী মৌজার চালা জমির রেট প্রতি শতাংশ ৩ লাখ ৭ হাজার ৫৬৩ টাকা। ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল ৩৪৬৪ নম্বর দলিলে ৪১ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। মৌজার রেট অনুযায়ী দলিলের মূল্য হওয়ার কথা এক কোটি ২৬ লাখ। কিন্তু ওই দলিলের মূল্য দেখানো হয়েছে ২০ লাখ টাকা। এ একটি দলিলেই রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে ১২ লাখ ২০ হাজার ১৬০ টাকা। এভাবে গত সাড়ে ৩ বছরে কয়েক হাজার দলিলে এভাবে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও মনিরুল সরকারকে বঞ্চিত করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top