নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রবর্তন | প্রকাশিতঃ ০৫:৩১, ০১ নভেম্বর ২০১৯
চলমান শুদ্ধি অভিযানে প্রায় ৫ হাজার অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিত নেতার সন্ধান পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের এসব নেতার তালিকা প্রস্তুত করেছেন দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তালিকাটি ইতিমধ্যে তিনি দলীয় নেতাদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। আট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা তালিকা ধরে ধরে তৃণমূল সম্মেলনের কাজে অংশ নেবেন। জেলা নেতাদের কাছেও একটি তালিকা পাঠাবে আওয়ামী লীগ। চূড়ান্ত তালিকায় থাকা অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিতদের সম্মেলনের মাধ্যমে পদ-পদবি থেকে বাদ দেয়া হবে।
পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সম্মেলনে তাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ থাকবে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্র আরও জানায়, টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশের ঢল নেমেছিল বিভিন্ন সময়ে। অনুপ্রবেশকারীর তালিকা করতে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বারবার তাগাদা দিয়েও কাজ হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও নিজস্ব টিমের তত্ত্বাবধানে দলে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিতদের তালিকা প্রস্তুত করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ তালিকা প্রস্তুত করতে প্রায় ৬ মাস কাজ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, এই মুহূর্তে দলকে সুসংগঠিত ও ‘হাইব্রিড’মুক্ত করতে নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। এরই অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা দলের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। সম্প্রতি গণভবনে ৬ জন নেতাকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দেন, এসব অনুপ্রবেশকারীকে এখনই দলের পদ-পদবি থেকে বাদ দিতে। একই সঙ্গে আগামীতে যেন অনুপ্রবেশ না ঘটে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের হাতে তালিকা দেয়ার নির্দেশ দেন।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা জেলায় জেলায় তালিকা পাঠাচ্ছি। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে বিত?র্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের একটি তালিকা নেত্রী (শেখ হাসিনা) বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়ে তৈরি করেছেন। সে তালিকা তিনি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন। বিতর্কিত কেউ যাতে বি?ভিন্ন পর্যায়ের সম্মেলনে কমিটিতে স্থান করে নিতে না পারেন, সেজন্য আমরা সতর্ক রয়েছি। নেতাকর্মীদের সেভাবেই দিকনির্দেশনা দেয়া আছে।
তিনি আরও বলেন, সম্মেলনকে সামনে রেখে এই তালিকার বাইরের স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতারা কমিটিতে স্থান পাবেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এ তালিকা পাঠানো হচ্ছে। সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা এটি সমন্বয় করবেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির সম্পাদকমণ্ডলীর সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, নেত্রী (শেখ হাসিনা) তার নিজস্ব কিছু লোক ও গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট সব মিলিয়ে খোঁজ নিয়ে এই তালিকা করেছেন। আমি নিজেও জেলার নেতাদের সঙ্গে বিতর্কিতদের তালিকা নিয়ে কথা বলেছি। তালিকায় থাকা বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীরা কাউন্সিলে কোনো ধরনের জায়গা না নিতে পারে, সেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, জঙ্গিবাদ, ভূমি দখলকারী, অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ও বিতর্কিতদের আওয়ামী লীগে স্থান হবে না।
চলমান শুদ্ধি অভিযানের জন্য সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানানো হয়। এ বিষয়ে কাদের বলেন, দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর এ শুদ্ধি অভিযানে অনেকে গ্রেফতার হয়েছে, নজরদারিতে আছেন অনেকে। ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও আছে কয়েকজনের বিরুদ্ধে। এ জন্য সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় আমরা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছি।
সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, বিএম মোজাম্মেল হক, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, আইন বিষয়ক সম্পাক শ ম রেজাউল করিম, দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুজ, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক শেখ আবদুল্লাহ, উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য রিয়াজুল কবীর কাওছার, মারুফা আক্তার পপি প্রমুখ।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব টিমের মাধ্যমে দলের অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরি করেছেন। সে তালিকা বিভাগীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের দিয়েছেন। আমরা তালিকা ধরে ধরে ব্যবস্থা নেব।
অন্যান্য বিষয় নিয়ে ওবায়দুল কাদের যা বললেন : ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের আরও জানান, মুজিবর্ষকে সামনে রেখে একটি বর্ণাঢ্য কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
নতুন সড়ক আইন নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, আইনে অনেক কিছুই লেখা আছে। আমরা আইনের হুবহু বাস্তবায়ন করছি। আইন নিয়ে অনেকের অনেক কথা আছে। কেউ বলছেন অপরাধীকে মাফ করে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এ আইনে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশ কমে আসবে। নতুন আইন সবাই মেনে চললে উপকৃত হবেন।
তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে পরিসংখ্যান, সেই পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের দুর্ঘটনা কিন্তু কমে গেছে। এখানে দুর্ঘটনা যতটা না বেশি তার চেয়ে ক্যাজুয়ালটিটা বেশি। দুর্ঘটনার মৃত্যু বেশি। ছোট ছোট যান যেমন নছিমন, করিমন এসব গাড়িতে টোকা লাগলেই বড় দুর্ঘটনা ঘটে। এজন্য হারটা বেশি। আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেই নির্দেশনা আমরা সবাই চালক যাত্রী পথচারী অনুসরণ করি তাহলে দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগের সম্মেলন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একই মঞ্চে হবে। সে লক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা এই বিষয়ে দেখভাল করছেন। জাতীয় কাউন্সিল উপলক্ষে করা উপকমিটিগুলো সভা করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে। অর্থ কমিটির বাজেট ঠিক করে ফেলেছেন। পার্টির সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে তারা বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন। প্রস্তুতি থেমে নেই, সম্মেলন সঠিক সময়ে হবে। ২০ ডিসেম্বর উদ্বোধন অনুষ্ঠান এবং ২১ ডিসেম্বর কাউন্সিল অধিবেশন।
ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা না হওয়া নেতাকর্মীদের মনে প্রশ্ন রয়েছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের বিষয়টি রয়েছে। আমরা অপেক্ষায় আছি নির্বাচন কমিশন সিডিউলটা কীভাবে দেয়। এই তিন মহানগরে নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার সঙ্গে মিল রেখে সম্মেলনের তারিখ দেয়া হবে। এই বিষয়ে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আওয়ামী লীগের জেলা ও সহযোগী সংগঠনগুলো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটি করবে। গঠনতন্ত্রে যেভাবে কমিটি করার দিকনির্দেশনা আছে, সে অনুযায়ী কমিটি করতে হবে। এ ব্যাপারে জেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে নির্দেশনা যাচ্ছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে সেতুমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা বলতে পারবে তার মেডিক্যাল বোর্ড। বোর্ড যেটা বলছে, সেটাই আমাদের বক্তব্য। বোর্ড তো বলেনি তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগের বিষয় আছে।
উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা সম্মেলনে থাকতে পারবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা যদি দলে থাকে, তাহলে সম্মেলনেও থাকতে পারবে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, এ পর্যন্ত ২৭টি জেলার সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সম্মেলন শেষ করা হবে। যেগুলোর কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে, সেগুলোর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্মেলন হবে। গত তিন বছরে আমাদের যত সাংগঠনিক কাজ হয়েছে, ’৭৫-পরবর্তী আওয়ামী লীগের ইতিহাসে এত কাজ আর হয়নি।