নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রবর্তন | প্রকাশিতঃ ০২:৪৪, ২৫ অক্টোবর ২০১৯
২০১২ সালের ৬ জুন মুগদা থানা উদ্বোধনের পরপরই প্রথম যে সাধারণ ডায়েরিটি (জিডি) নথিভুক্ত হয়, সেটি ছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর বিএম সিরাজুল ইসলাম ভাট্টির বিরুদ্ধে। জিডিতে ভাট্টির নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন একই ওয়ার্ডের (সাবেক ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড) সাবেক কমিশনার বাসাবোর ১০৩ উত্তর মুগদার বাসিন্দা এনামুল হক সরদার।
এনামুল হক সরদার বলেন, সিরাজুল ইসলাম ভাট্টির কোনো ব্যবসা ছিল না। পৈতৃক কোনো সম্পত্তিও ছিল না। চাঁদাবাজিই তার ব্যবসা। তার সহায় সম্পত্তির সবকিছুই চাঁদাবাজির টাকায়। মাদক ব্যবসা, হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, ভর্তিবাণিজ্য, লেগুনা-টেম্পো-রিকশা থেকে চাঁদা আদায় ও অন্যের জমি দখল করেই আজ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন তিনি। কাউন্সিলর হওয়ার পর তার এসব অপকর্ম বেড়ে গেছে। তিনি কিশোর গ্যাংসহ নানা বাহিনী গড়ে তুলেছেন।
মুগদা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক একজন সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিরাজ ভাট্টি এলাকার পরিবেশ এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন যে, কোন অনুষ্ঠানে কাকে ওই ব্যক্তি দাওয়াত দেবে, সেটাও আগে তাকে জানাতে হয়। তার মনমতো কাউকে দাওয়াত না দিলে সবাইকে ওই অনুষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধ করেন ভাট্টি।
৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ওয়ালিউল্লাহ জুম্মন বলেন, তার সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। বললে বিপদ আরও বাড়তে পারে।
বরিশালের আগৈলঝাড়ার চাদত্রিসিরা গ্রামের কফিল উদ্দিনের ছেলে সিরাজুল ইসলাম ভাট্টি গত শতকের শেষদিকে উত্তর মুগদার ঝিলপাড়ে একটি মেসে ওঠেন। পরে আব্দুস সোবহানের বাড়িতে জায়গীর থাকা শুরু করেন। একসময় অগ্রণী ব্যাংকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরি পান। পরে কদম আলীর কন্যা কানিজ ফাতেমা তমার সঙ্গে হৃদ্যতার সূত্রে বিয়ে হয় তার। তমা বর্তমানে ওয়ার্ড যুব মহিলা লীগের সভাপতি। সিরাজ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ৩৩ নম্বর সদস্য। জায়গীর থাকা ও পরবর্তী সময়ে বিয়ে করার কারণে এলাকায় অনেকেই তাকে জামাই সিরাজ বা জায়গীর সিরাজ হিসেবে সম্বোধন করেন।
স্থানীয়দের ভাষ্য, তমাকে বিয়ে করার পর মুগদা আওয়ামী লীগ নেতা এনাম সরদার ও নজরুল সরদারের নজরে পড়েন সিরাজ। অগ্রণী ব্যাংকের চাকরি বাদ দিয়ে তাদের হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। অথচ সরদাররাই এখন বলছেন, সেই জামাই সিরাজ এখন ৫-৬টি বাড়ির মালিক! শ্যালক রুবেলের নামে ‘ফ্যামিলি হাউজিং এস্টেট লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানিও খুলেছেন তিনি। সম্প্রতি অভিযান শুরুর পর কাউন্সিলর সিরাজ সব টাকা-পয়সা কোথায় লুকাবেন দিশা পাচ্ছেন না।
কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকেই শনৈঃশনৈঃ উন্নতি হয়েছে সিরাজ ভাট্টির। জায়গীর মাস্টারের উত্থান দেখে এলাকার সবাই এখন বিস্মিত। ১৩৯ দক্ষিণ মুগদাপাড়ায় তৈরি করেছেন সাততলা আলীশান বাড়ি। নিচতলার সামনের পুরোটাই টাইলসে সাজানো। আছে কিছু সজ্জিত বৃক্ষরাজি। ‘নোঙর’ নামের ওই বাড়িতেই তিনি থাকেন। নিচতলার একাংশ ব্যবহার করেন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় হিসেবে। ১৪২ দক্ষিণ মুগদাপাড়া হোল্ডিংয়ে তৈরি করেছেন সুরাইয়া হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। পাঁচতলা হাসপাতালটির ভবনসহ হাসপাতালেরও মালিক সিরাজ। এ ছাড়া মুগদার ফ্যামিলি হাউজিংয়ে একাধিক ফ্ল্যাটও আছে তার।
ডেভেলপারের ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত হয়েছেন সিরাজ। অনেকের কাছ থেকে জোর করে জমি নিয়ে ডেভেলপ করেন তিনি। সাইনিং মানির টাকাও ঠিকমতো দেন না। ওই এলাকায় অন্য ডেভেলপাররা কাজ করতে পারেন না। কিছুদিন আগে আরেকটি ডেভেলপারের একটি ভবন দখল করে নিয়ে বাকি কাজ করছেন তিনি। ওই ডেভেলপার যেটুকু কাজ করেছিলেন, সেটুকুর বিলও দেননি। চাঁদাবাজির জন্য তার আলাদা বাহিনী আছে। এ ছাড়া ভর্তিবাণিজ্য, মাদক কারবার, কিশোর গ্যাং গড়ে তোলা এবং এলাকার বাড়িঘর নির্মাণে ঠিকাদারিসহ সবকিছুই তার হাতে।
সিরাজ কৌশলে স্থানীয় এমপির আস্থাভাজন হয়েছেন। আইডিয়াল স্কুলের মুগদা শাখা চালু হওয়ার পর থেকেই ভর্তিবাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক তিনি। তিনি ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিংবডির সদস্য। আগে ছাত্রছাত্রী ভর্তিতে ৩০-৫০ হাজার টাকা করে নিলেও এখন সিরাজ নেন ২ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা। ডোনেশনের বাইরে সিরাজকে এই টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া মুগদা জেনারেল হাসপাতালে আউটসোর্সিংয়ের সব লোক দেন সিরাজ। তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি নিয়োগ দিতে নেন এক লাখ টাকা করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওইসব জনবলের মজুরির টাকা পরিশোধ করলেও সিরাজ তাদের ঠিকমতো বেতন দেন না। দিলেও মাসিক বেতনের একটি অংশ কেটে নেন। হাসপাতালের খাবার সরবরাহও করেন সিরাজ। তার বিরুদ্ধে নিম্নমানের ও পরিমাণে কম খাবার দেওয়ার অভিযোগও আছে। ওয়াসার পাম্পের জায়গা দখল করে সেখানে তার লোকজন বসিয়ে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। ‘লাইনম্যান’ জয়নালকে দিয়ে এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় দোকান বসিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন তিনি। এসব কাজে তার সহযোগী হিসেবে আছে ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা শামীম, ফ্রিডম পার্টির সাবেক কর্মী রাজা ওরফে ফ্রিডম রাজা ও যুবলীগের ওয়ার্ড সভাপতি নুরুল ইসলাম। শ্রমিক লীগের এনামুল হককে দিয়ে এলাকায় হাট বসিয়ে প্রতিদিন চাঁদা তোলেন সিরাজ। মুগদা এলাকায় বাড়ি তৈরি করতে হলে সিরাজকে চাঁদা দিতেই হয়। স্থানীয় ব্যাংক কলোনির এক বাসিন্দা জানান, বাড়ির কাজ শুরুর পর সিরাজের অনুসারী রাজা ও রাজিব মিষ্টি খাওয়ার কথা বলে তার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। ইট-বালু সরবরাহও তারা করবে বলে সিদ্ধান্ত দেয়। পরে ওই ব্যক্তি র্যাবের কাছে অভিযোগ করেছেন।
দক্ষিণ মুগদার এক বাসিন্দা জানান, মুগদা জেনারেল হাসপাতালে সিরাজের রয়েছে বিশেষ বাহিনী। কোনো রোগী এলে তাদের সিরাজের সুরাইয়া হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করতে বাধ্য করা হয়। সব পরীক্ষা ওখান থেকে করতে হয়।
সিরাজের রয়েছে বিশাল কিশোর গ্যাং। এসব কিশোর অপরাধী বিভিন্ন নামে গ্রুপ খুলে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, পথেঘাটে নারী উত্ত্যক্তসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের হাতে বেশ কয়েকটি খুনোখুনিও হয়েছে। গত আগস্ট মাসে র্যাবের অভিযানে ‘চান-যাদু (জমজ ভাই)’, ‘ডেভিল কিং ফুল পার্টি’, ‘ভলিয়ম টু’ এবং ‘ভা ারি গ্রুপ’সহ সিরাজের কিশোর গ্যাংয়ের ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের তিন মাস কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। স্থানীয়রা বলছেন, গ্যাংয়ের সদস্যরা তার মিছিল-মিটিংয়ে যায়। তাদের বয়স ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।
মুগদার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন সিরাজ ভাট্টি। মুগদা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শামীম, যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলামসহ কয়েকজন তার প্রধান সহযোগী। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রতিবেদনেও তাদের নাম উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতার নেতৃত্বে মুসা, টুইল্যা, রুবেল ও সাজু মাদক ব্যবসা করে। সিরাজের মাদক ব্যবসায় সহযোগিতার কারণে সম্প্রতি মুগদা থানার এএসআই সোহরাওয়ার্দী হোসেন, কনস্টেবল আসাদুর রহমান, খিলগাঁও থানার এএসআই মজনু হোসেন, মুগদা থানার সাবেক এসআই মিজানুর রহমান, খিলগাঁওয়ের এএসআই আবদুল ওয়াদুদ, এএসআই সেলিম হোসেন, এএসআই জয়নুল আবেদীন, এএসআই খালেদুর রহমান ও এএসআই মো. আক্তারুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে ডিএমপি।
কাউন্সিলরের বক্তব্য :এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর সিরাজ বলেন, যেসব অভিযোগের কথা উঠছে, এসবের একটির সঙ্গেও তিনি জড়িত নন। তিনি চ্যালেঞ্জ করে বলেন, যারা অভিযোগ করছেন, তাদের কেউ তার সামনে একটি অভিযোগও করতে পারবেন না। কখনই তিনি ভর্তিবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কোনো চাঁদাবাজির সঙ্গেও তিনি নেই। কোনো মাদক ব্যবসার সঙ্গেও তিনি জড়িত নন। কোনো অবৈধ পথেও তিনি টাকা-পয়সার মালিক হননি। এসব ব্যাপারে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে সেটা গ্রহণ করতে রাজি আছেন তিনি।