খুলনায় চেয়ারম্যান আনিছের কোটি টাকার ‘ঘুষকান্ড’ তদন্তে সরকারের তিন বিভাগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রবর্তন | প্রকাশিতঃ ১৯:০৮, ২৫ অক্টোবর ২০১৯

প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের ‘জমি আছে ঘর নাই প্রকল্পে’ খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার যোগীপোল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমানের ব্যাপক অনিয়ম দূর্ণীতির তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়, দুর্নীতি দমক কমিশন (দুদক) ও স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে এ তদন্ত চলছে। প্রাথমিকভাবে ভূমিহীনদের ঘর দেয়ার নামে তাদের কাছ থেকে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। প্রবর্তনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় সরকার বিভাগ, খুলনার উপ পরিচালক ইশরাত জাহান।

যোগীপোল ইউনিয়নের হতদরিদ্র মানুষেরা সরকারের এ প্রকল্পের সুবিধা পেতে বিভিন্ন ভাবে ধার দেনা করে টাকা তুলে দিয়েছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমানের হাতে। কেউ বা সর্বস্ব বিক্রি করেছিলেন একটি ঘরের আশায়। তাদের ভাষ্যমতে, ঘর পেতে হলে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে – এমনটাই বলেছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান।

সরকারি ঘরের আশায় চেয়ারম্যানের দাবী পূরণ করতে এনজিও’র কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন হতদরিদ্র রেজাউল করিম। একটা মাথা গোজার ঠাঁই হলে আস্তে আস্তে এনজিও’র টাকা শোধ করার আশা ছিল তার। কিন্তু ঘরের আশায় দু’বছর ঘুরতে হয়েছে চেয়ারম্যানের পিছনে। ঘর আর পাওয়া হয়নি তার। ততদিনে এনজিও’র ঋণের সুদ বেড়ে দ্বিগুন হয়েছে। এখন এলাকা ছাড়ার মত অবস্থা তার। রেজাউল ইসলাম খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার যোগীপোল ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তার অভিযোগ, ঘর পাওয়ার আশ্বাসে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমানকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে ঘর দেওয়া হয়নি। এদিকে টাকা ফেরত চেয়েও পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন তিনি। তার মত ওই ইউনিয়নের ৩ শতাধিক হতদরিদ্র মানুষ টাকা দিয়ে একদিকে ঘরের আশায় দিন গুনছেন, অন্যদিকে এনজিও’র সুদের টাকার চাপ বয়ে বেড়াচ্ছেন।

এসব পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের ‘জমি আছে, ঘর নেই’ প্রকল্পের আওতায় যোগীপোল ইউনিয়নে ১২০ জন গৃহহীনকে প্রতিটি এক লাখ টাকা ব্যায়ে গৃহ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ওই প্রকল্প কমিটির সদস্য হিসেবে যোগীপোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান ঘর নির্মাণ কাজের তত্বাবধায়ন করছেন। অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প শুরুর আগেই তিনি নিজস্ব লোক দিয়ে ৫০০ জন সুবিধাভোগীর তালিকা তৈরী করে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে অগ্রিম ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন। এর মধ্যে ১২০ জন ঘর পেয়েছেন। বাকি ৩৮০ জন ঘর না পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগসহ এলাকায় একাধিকবার ঝাড়ু মিছিল করেছেন। কয়েকদিন আগে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) উপস্থিতিতে আলী হাওলাদার নামে এক ভূক্তভোগীর ঘুষের ১০ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান। এ সংক্রান্ত সংবাদ বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

আরো পড়ুন: খুলনায় ‘জমি আছে, ঘর নেই’ প্রকল্পের ঘুষের টাকা ফেরত দিলেন ইউপি চেয়ারম্যান

এর আগে ঘুষের টাকা ফেরত পেতে এলাকার দুই শতাধিক মানুষ খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন শেষে ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন। এছাড়া ঘুষের টাকার ফেরতের দাবীতে সহকারি কমিশনারের (ভূমি) অফিসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন স্থানীয়রা।

ভূক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ঘর পাওয়ার আমায় চেয়ারম্যানের দাবী পূরণ করতে কেউ এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন, কেউ স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে চড়া সূদে টাকা নিয়েছেন। এখন ঘর পাওয়ার আশা ছেড়ে তারা এনজিও’র ঋণ পরিশোধে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

এদিকে, বিভিন্ন সময়ে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমান বরাবরের মতো তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, নির্বাচনী প্রতিপক্ষ এলাকার কিছু মানুষকে উষ্কানি দিচ্ছেন। তাদের উষ্কানীতে এসব হচ্ছে বলে দাবী করেন তিনি। ইউএনও’র উপস্থিতিতে টাকা ফেরত প্রসংগে তিনি বলেন, একটি ঘর ভেঙে ফেলার ক্ষতি পূরণ বাবদ ইউএনও টাকা ফেরত দিয়েছেন।

দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাফিজ আল আসাদ বলেন, প্রকল্পটি আমার যোগদানের আগেই শুরু হয়েছে। যোগীপোল ইউনিয়নে এ প্রকল্পের ঘর পাওয়া নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের কাছ থেকে অভিযোগ আমি পেয়েছি। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালক ইশরাত জাহান বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়, দুদক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে তদন্ত চলছে। দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন হাতে পেলে মন্ত্রনালয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top