দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করেছেন ফখরে আলম

ডেস্ক রিপোর্ট : বস্তুনিষ্ঠ, অনুসন্ধানী ও মানবিক সাংবাদিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ যশোরের কবি ও সাংবাদিক ফখরে আলম। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গণমানুষের কাছে একজন দায়িত্বশীল পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে তিনি অতিপরিচিত। সাংবাদিকতার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা ও সংবাদ পরিবেশনে নিরপেক্ষতা তার সাংবাদিকতা পেশাকে সাফল্যময় ও প্রশংসনীয় করেছে।

ফখরে আলম অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করেননি। স্বার্থ, প্রলোভন, অর্থবিত্ত তার কলমকে কোনো দিন থামাতে পারেনি। পত্রিকার নীতিমালা অনুসরণ করে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে অনুসন্ধানী ও মানবিক সাংবাদিকতা করে গেছেন তিনি।

পরিচিতি
১৯৬১ সালের ২১ জুন যশোরে গৃহিণী রওশন আরা বেগম ও পুলিশ কর্মকর্তা শামসুল হুদার কোলজুড়ে জন্ম নেন ফখরে আলম। ১৯৭৭ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। ১৯৭৯ সালে সরকারি এমএম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৮১ সালে এমএম কলেজ থেকে বিকম পাস করেন তিনি। ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এ কৃতী মানুষ।

সাংবাদিকতার হাতেখড়ি
ছাত্রজীবন থেকেই সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত হন ফখরে আলম। তার প্রথম কর্মস্থল ছিল সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকা। ১৯৮৫ সালে রোববার-এ যোগাদান করে পেশাদার সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৯১ সালে আজকের কাগজ-এর যশোর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। এরপর ভোরের কাগজ, বাংলাবাজার পত্রিকা, মানবজমিন, জনকণ্ঠ, আমাদের সময়, যায়যায়দিন এবং সর্বশেষ কালের কণ্ঠ-এ কাজ করেছেন।

১৯৯২ সাল থেকে কর্মস্থলে বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতি পেয়ে স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র রিপোর্টার এবং বিশেষ প্রতিনিধি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কালের কণ্ঠ-এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন সাংবাদিক ফখরে আলম।

প্রকাশিত বই
ফখরে আলম মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে দীর্ঘ ৩০ বছর সাংবাদিকতা করেছিলেন। এ ছাড়া অপরাধ, দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় দুঃসাহসী ছিলেন তিনি। শুধু সাংবাদিকতা নয়, অবসর সময়ে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৩৮টি বইও লিখেছেন।

তার মধ্যে ‘রিপোর্টারের ডায়েরি’, ‘হাতের মুঠোয় সাংবাদিকতা’, ‘ডাকে প্রেম তুষার চুম্বন’, ‘যশোরের গণহত্যা’, ‘তুই কনেরে পাতাসী’, ‘খুলে ফেলি নক্ষত্রের ছিপি’, ‘এ আমায় কনে নিয়ে আলি’, ‘অন্ধকার চূর্ণ করি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

যশোর শহরের চাচড়া ডালমিল এলাকায় ফখরে আলমে বাড়ি ‘হুদা কটেজে’ গেলে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার স্ত্রী নাসিমা আলমের।

তিনি জানান, দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তিনি খুব সুখে আছেন। মেয়ে নাজিফা আলম মাটি সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক পাস করেছেন। তাকে খুলনায় একটি ভালো পরিবারের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে ছেলে ফাহমিদা হুদা বিজয় উচ্চমাধ্যমিক পাস করে শহরের এমএম কলেজে মার্কেটিংয়ে অনার্স অধ্যয়নরত। ছেলেকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকলেও স্বামীর মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। তার রেখে যাওয়া সব স্মৃতি বারবার তাড়া করে। জীবনসঙ্গীর বিয়োগব্যথা দিনের পর দিন চোখের পানিতে অনুভব করছেন নাসিমা আলম।

নাসিমা বলেন, ফখরে আলমের জীবনের গল্প বলে শেষ করার মতো নয়। যশোর শহরে তিনি শুধু সাংবাদিকতা করেননি, তিনি মানুষের জন্য সাংবাদিকতা করেছেন। তার লেখালেখির মধ্য দিয়ে অনেক পরিবার সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে। অনেক হতদরিদ্র শিক্ষার্থী সুশিক্ষিত হতে পেরেছেন। শুধু আমি নই, গোটা যশোর তাকে নিয়ে গর্ব করে। তিনি দুঃসাহসিক লেখালেখিও করতেন। তিনি তার সাংবাদিকতার জীবনে কখনো কারও কাছে বিক্রি হননি। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে থেকে কলমসৈনিকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এরশাদ শিকদারকে নিয়েও তিনি প্রথম জাতীয় দৈনিকে লেখালেখি করেন।

সাংবাদিকতার শুরুতে ফখরে আলম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা শুরু করেন। ২০০০ সালে জনকণ্ঠ-এ তিনি সবচেয়ে সাড়া জাগানো ধারাবাহিক প্রতিবেদন ‘সেই রাজাকার’ লেখা শুরু করেন। তিনি অনুসন্ধান চালিয়ে যশোরে কয়েকটি বধ্যভূমি খুঁজে বের করেছেন।

২০০১ সালে যশোর সদর উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের একাত্তরে মুখে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৩০ বছর হাঁ করতে না পারা রাহেলাকে নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেন। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর সেনাপ্রধানের নির্দেশে যশোর সিএমএইচ হাসপাতালে অপারেশন করে রাহেলার মুখ থেকে গুলি বের করা হয়।

যত পুরস্কার
সাংবাদিকতার জন্য ১৯৯৭ সালে ফখরে আলম মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি পুরস্কার পান, একই বছর এফপিএবি পুরস্কার, ২০০০ সালে মধুসূদন একাডেমি পুরস্কার, ওই বছরই বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম পুরস্কার, ২০০২ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার এবং বৃক্ষরোপণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য ফখরে আলম ২০০৬ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় পুরস্কার ও ২০০৭ সালে প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় পুরস্কারসহ অর্ধশতাধিক পুরস্কার অর্জন করেন।

সামাজিক অবদান
ফখরে আলম বেঁচে থাকতে চচড়ার ভাতুড়িয়ায় তার গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানের অর্ধেকাংশ এলাকাবাসীর কবরস্থান হিসেবে দান করে দেন। এ ছাড়া তিনি গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্যও সরকারের কাছে জমি দান করেছেন। ফখরে আলমের নামে যশোর আদ্বদীন্ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি লেকচারার হল রুম রয়েছে। যেটির উদ্বোধন তিনি নিজেই করেন।

যশোর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদুর রহমান বলেন, সাংবাদিক ফখরে আলম বহুমাত্রিক প্রতিভাধর একজন মানুষ ছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি যেমন যশোরের সাংবাদিকতা সমৃদ্ধ করেছেন, তেমনি যশোরের সাংবাদিকতাকে মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছেন। পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখ, দুর্দশা ও বঞ্চনা নিয়ে লেখালেখি করে দুই বাংলার কাছে যশোরকে পরিচিত করার পেছনে তার ভূমিকা অসাধারণ।

তিনি আরও বলেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় ফখরে আলমের জুড়ি মেলা ভার। তিনি ত্যাগ স্বীকার করে তৃণমূল পর্যায়ে থেকে সাংবাদিকতা করে গেছেন। সাংবাদিক ফখরে আলম আমদের গর্ব।

অগ্রজ-অনুজদের কাছে ফখরে আলম
নতুন প্রজন্মের সংবাদকর্মী ঢাকা মেইলের যশোর প্রতিনিধি ইমরান হোসেন পিংকু বলেন, আমরা নতুন প্রজন্মের সংবাদকর্মী। আমাদের কাছে সাংবাদিক ফখরে আলম একজন গর্বের নাম। তার মধ্যে যে আদর্শ, নীতি, নৈতিকতা, সংবাদ পরিবেশনে দূরদর্শিতা ছিল, সেসব সম্পর্কে তার লেখা বই ও জবনী থেকে সংগ্রহ করে মেনে চলার চেষ্টা করি। কবি ও প্রথিতযশা সাংবাদিক ফখরে আলম এ পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। কিন্তু তার সাংবাদিকতা জীবনে যে অবদানগুলো রয়েছে, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের মাঝে। আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

দৈনিক যশোর পত্রিকার অপরাধ প্রতিবেদক ওবায়দুল ইসলাম অভি বলেন, ফখরে আলম তার সাংবাদিকতার জীবনে যেমন মানবিক সাংবাদিকতা করেছেন, তেমনি দুঃসাহসিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন। তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কখনো প্রলোভন দেখিয়ে দমিয়ে রাখতে পারেনি। যশোর সাংবাদিক সমাজে ফখরে আলমে শূন্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়।

যশোরের স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক সমাজের কথার নিজস্ব প্রতিবেদক হাসমী সাজু বলেন, সাংবাদিক ফখরে আলমের হাত ধরে আমি সাংবাদিকতার হাতেখড়ি নিয়েছিলাম। তিনি প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। তিনি যখন মারা যান, আমাদের মনে হলো ‘একজন অভিভাবক আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন’। সাংবাদিক ফখরে আলমকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

ফখরে আলম ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এরপর থেকে তিনি ভারতের টাটা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে শুরু করেন। ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল ক্যানসারের কারণে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ২০২০ সালের ১৪ মে সকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে যশোর ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান কবি ও সাংবাদিক ফখরে আলম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top