যশোর প্রতিনিধি : চলমান বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় সারাদেশের মতো যশোরেও চলছে সিডিউল লোডশেডিং। এতে যশোরের গাড়ি শিল্পে চরমভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শহরের মনিহার থেকে মুড়ুলী মোড় পর্যন্ত কারখানাগুলোতে গাড়ির বডি এবং পার্টস উৎপাদন কমেছে তিন ভাগেরও কম। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে চাহিদা অনুযায়ী অর্ডার নিতে পারছেন না গাড়ি কারখানা ও ওয়ার্কশপ মালিকরা।
লোডশেডিংয়ের হাত থেকে বাঁচতে কেউ কেউ বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে জেনারেটর বেছে নিয়েছেন। তবে জ্বালানি তেল দিয়ে জেনারেটর চালাতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে উভয় দিক দিয়ে লোকসানের মুখে পড়ছেন গাড়ি শিল্পের উদ্যোক্তারা।
যশোর শহরের মনিহার থেকে মুড়ুলী পর্যন্ত গাড়ির কারখানা এবং ওয়ার্কশপগুলো ঘুরে জানা যায়, কারখানাগুলোতে সার্বক্ষণিক উৎপাদন চালু রাখার জন্য লাইনের বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে ফার্নেস অয়েল দিয়ে জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে ব্যয় ৩০ শতাংশ বাড়ছে। এ অবস্থায় অতিরিক্ত ব্যয় বহন করার সক্ষমতা না থাকায় অনেক কারখানা মালিক বাধ্য হয়ে গাড়ির বডি এবং পার্টস উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন।
কারখানা ও ওয়ার্কশপ মালিকরা জানান, গত দুই বছর করোনার কারণে বাজার মন্দা ছিল। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে কাঁচামালের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে ছিলেন তারা। এরই মধ্যে চলমান বিদ্যুৎ সংকট তাদের আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
বিগত পাঁচ দশকে গাড়ি শিল্প বলতে সবই আমদানি নির্ভর ছিল। ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে গাড়ির বডি (চ্যাসিস) ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা হতো। কিন্তু বর্তমানে যশোরেই প্রস্তুত করা হয় গাড়ির যন্ত্রাংশ ও বডি। এতে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। যশোরের অটোমোবাইলস শিল্পের সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। প্রযুক্তিগত মেশিনারির ব্যবহার ছাড়াই বিভিন্ন নামিদামী বিদেশি ব্র্যান্ডের গাড়ির বডি তৈরি করে দেশজুড়ে খ্যাতি কুড়িয়েছে জেলার ওয়ার্কশপ ও কারখানাগুলো।
যশোর শহরের বকচর, হুশতলা-মুড়লি মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় আট শতাধিক অটোমোবাইলস ওয়ার্কশপ রয়েছে। এসব ওয়ার্কশপে পাঁচ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করছেন। ওয়ার্কশপগুলোতে নতুন বাস-ট্রাকের বডি তৈরি, পুরাতন বডি সংস্কার, রং, ওয়ারিং ও ইঞ্জিন মেরামত কাজ করে প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা আয় হয়।
যশোরের মুড়লী মোড়ের ওয়ার্কশপ মালিক সাইফুল বলেন, বিদুৎ বিপর্যয়ের কারণে ওয়ার্কশপের বিভিন্ন কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। যে কাজে বিদ্যুতের ব্যবহার রয়েছে সে কাজ বিদ্যুৎ আসলে করতে হচ্ছে আর বিদ্যুৎ যখন থাকছে না, তখন অন্য কাজ করতে হচ্ছে। এতে করে ৮ দিনের কাজে ১০ থেকে ১৬ দিনের মতো সময় লাগছে।
বকচর এলাকার হিটু ওয়ার্কশপের মালিক হিটু আলম বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গাড়ির মালিকরা তাদের গাড়ির বড় বড় কাজ নিয়ে যশোরে আসেন। আমরা এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী কাজ শেষ করে বুঝে দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু করোনার ধাক্কা সামলে আবার যখন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি তখন এই লোডশেডিংয়ের কারণে আরও লোকসান গুনতে হচ্ছে। শ্রমিকদের কাজে সময় লাগছে। ফলে গাড়ি উৎপাদন বা সার্ভিসিংয়ে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
ঈগল বডি হাউসের শ্রমিক ইয়াসিন বলেন, ১২ ঘণ্টার মধ্যে যশোরে ছয় ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকে না, তাহলে কাজ করব কখন। লোডশেডিংয়ের কারণে আমাদের কাজে সময় বেশি লাগছে। একটা গাড়ির বডি বানাতে দ্বিগুণ সময় লাগছে। মহাজন রাগারাগি করে। সময়মতো কাজ বুঝে দিতে না পারলে টাকা কম। সব দিক দিয়ে দেখা যায় মালিকের সঙ্গে আমাদেরও ক্ষতি হচ্ছে।
যশোর ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির সভাপতি বাবুল আলম বাবু বলেন, আমাদের এখানে প্রায় ৮০০টি ওয়ার্কশপ আছে। যেখানে খুলনা বিভাগসহ অন্যান্য জেলা থেকে অনেক গাড়ি কাজ করাতে আসে বা আমাদের নতুন গাড়ি তৈরির অর্ডার দেয়। একটা গাড়ির বডি বানাতে যেখানে এক মাস সময় লাগতো, সেখানে লোডশেডিংয়ের কারণে সময় লাগছে দুই মাস। ফলে গাড়ির মালিকদের সঙ্গে আমাদের এগ্রিমেন্ট হেরফের হচ্ছে। আমরা সময়মতো গাড়ি ডেলিভারি দিতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, এই গাড়ি শিল্পের দিকে সরকারের একটু বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। না হলে এ শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে এবং অনেক শ্রমিককে না খেয়ে থাকতে হবে।
যশোর ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ইখতিয়ার উদ্দিন বলেন, যশোরে বিদ্যুতের চাহিদা ৫৫ থেকে ৬০ মেগাওয়াট। আমরা চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম পাচ্ছি। এজন্য সিডিউল করে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। তবে গাড়ি শিল্প বা অনান্য শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দিকে আমরা বিশেষ নজর দিচ্ছি। আশা করা যায় চলতি বছরের অক্টোবর মাসে বিদ্যুতের এই সংকটের অবসান ঘটবে।