ডেস্ক রিপোর্ট : দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে ১১ নং সেক্টরের যুদ্ধ করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হাফিজুর রহমান (৭০)। দেশকে হানাদারমুক্ত করতে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেও সেই স্বাধীন দেশে আজ তিনি নিজেই গৃহহীন, এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ করা সম্মানী ভাতা থেকেও বঞ্চিত।
মঙ্গলবার (২২ জুন) দুপুরে বগুড়া প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন যুদ্ধকালীন কমান্ডার ও সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে দুর্ভোগের এসব কথা জানান ভারতীয় তালিকা ও মুক্তিবার্তা তালিকাভুক্ত এই মুক্তিযোদ্ধা।
হাফিজুরের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার রতনপুর গ্রামে। সেখানে তিনি একটি মসজিদে মুয়াজিনের দায়িত্ব পালন করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। থাকছেন অন্যের দেওয়া এক খণ্ড জমিতে একটি কুঁড়েঘরে।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশকে হানাদারমুক্ত করার জন্য নিজ এলাকা ফুলছড়ি থেকে ভারতীয় মেঘালয় রাজ্যে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কমান্ডার মো. খায়রুল ইসলামের অধীনে ২৩ দিনের প্রশিক্ষণ নিই। পরে তার ৩ নং প্লাটুনের কমান্ডার ইব্রাহিম খলিল্লাহ একটি এসএলআর তুলে দেন হাতে। তারপর শুরু করেন পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
তিনি আরও জানান, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার ভারতীয় তালিকা নং ৪১৯২৫ এবং লাল মুক্তিবার্তা তালিকায় তার নম্বর ০৩১৭০৪০১৯১। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের (বামুস) সনদ নং ২৫৬৭৬২। অস্ত্র হাতে তিনি যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন, তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে তিনি ভূমিহীন হন। তার ঠাঁই হয় বণ্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে। সেই বাঁধ সংস্কার ও সুরক্ষার উদ্যোগ নিলে ২০১৯ সালে উচ্ছেদ হন। তারপর থেকে থাকের অন্যের দেওয়া একখণ্ড জমিতে। বয়সের ভারে কাজ করতে পারেন না হাফিজুর। তাই এলাকাবাসী একটি মসজিদে মুয়াজিনের দায়িত্ব দেন। সেখান থেকে পাওয়া সামান্য অর্থে চলে তিনি ও তার বৃদ্ধ স্ত্রীর জীবিকা।
২০১০ সাল থেকে দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বরাবর বহুবার লিখিত আবেদন করেছেন। কিন্তু পাননি কোনো সমাধান।
সম্প্রতি গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশনা বিষয়ে হাফিজুর জানান, তাদের নির্দেশে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা কমিটির সদস্যসচিব একটি তদন্ত করে তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা (হাফিজুর রহমান) এবং ভাতা পাওয়ার যোগ্য, সে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। যথারীতি ওই তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা ভাতা বায়স্তবায়ন কমিটি তার ভাতার প্রাপ্তির বিষয়টি অনুমোদনও করেছে। তারপরও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা থেকে বঞ্চিত তিনি।
এই বঞ্চনার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, জেলার ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সাব এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার জোবায়ের হোসেন চৌধুরীর অনৈতিক আবদার পূরণ না করায় তিনি প্রাপ্য ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সংবাদ সম্মেলনে কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, সাংবাদিক ভাইয়েরা সংবাদমাধ্যমে আমার এই অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরলে আমার বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এর সুরাহা করবেন।
হাফিজুরের সহযোদ্ধা মো. ইব্রাহিম খলিল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, যখন শুনি আমার সহযোদ্ধা হাফিজুর রহমান অনাহারে ও কষ্টে আছে, তখন আর নিজের খাওয়াদাওয়া ভালো লাগে না। সে কারণে ময়মনসিংহের মুক্তগাছা থেকে সহযোদ্ধার পক্ষে কথা বলার জন্য বগুড়া প্রেসক্লাবে এসেছি আমি।
কমান্ডার খায়রুল ইসলাম জানান, জীবনবাজি রেখে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হাফিজুর রহমান দেশকে হানাদারমুক্ত করেছেন। অথচ সেই স্বাধীন দেশে আজ হাফিজুর নিজেই গৃহহীন, এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ করা সম্মানী ভাতাটুকু থেকেও বঞ্চিত। এটা ভাবা যায় না। এ বিষয়ে সরকার সুদৃষ্টি দিলে তিনি তার সম্মানী ভাতা ফিরে পাবেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন ১১ নং সেক্টরের কমান্ডার খায়রুল ইসলাম, সহযোদ্ধা মো. ইব্রাহিম খলিল্লাহ, মোজা ব্যাপারী, আব্দুর রশিদ, নুরুজ্জামান প্রমুখ।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে ফুলছড়ি উপজেলা নিবাহী কমকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. আলাউদ্দিন জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন রাজাকার বাহিনীর সদস্য থাকার অভিযোগ জমা পড়ে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তার বিপক্ষে বলার কারণেই তার ভাতা বন্ধ হয়েছে। হাফিজুর রহমানের বিষয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। সামনে তিনি ভাতা পেতে পারেন।