দেশে গত সাড়ে তিন মাসে আগ্রহী ৯৫ শতাংশ মানুষ নানাভাবে চেষ্টা করেও করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করাতে পারেননি। এজন্য সিরিয়াল পাওয়াই তাদের কাছে কঠিন বিষয় ছিল। ল্যাবের অভাব দেখিয়ে অনেককে বাড়িতে থাকতে বলা হয়েছে।
দেশের ৪৪ জেলায় পরীক্ষা করার মতো পরীক্ষাগার নেই। সংকট ল্যাব চালানোর মতো দক্ষ জনবলের। যথেষ্ট পরিমাণে নেই প্রশিক্ষিত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। এ অবস্থায় নানাভাবে চেষ্টা করে তারা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের কাছে নমুনা পরীক্ষার বিষয়টি ‘সোনার হরিণ’ হয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।
দেশে সংক্রমণ শুরুর পর থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন হট নম্বরে উপসর্গসহ এবং উপসর্গহীন মানুষ নমুনা পরীক্ষার পাশাপাশি সহায়তা চেয়ে টেলিফোন করেছেন এক কোটি ১১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩২ জন। এদের মধ্যে গত রোববার পর্যন্ত পাঁচ লাখ ১৬ হাজার ৫০৩ জন পরীক্ষা করাতে পেরেছেন। অবশিষ্ট এক কোটি ছয় লাখ ২৯ হাজার ১২৯ জন চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি।
এরাই হচ্ছেন আগ্রহী সেই ৯৫ শতাংশের কিছু বেশি মানুষ। বাকি প্রায় সাড়ে চার শতাংশ চেষ্টা করে সফল হয়েছেন। ব্যর্থ সেই ৯৫ শতাংশের অধিকাংশ মানুষ সংক্রমণ ঘটিয়ে চলেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন হট নম্বরে ফোন করেছেন তাদের উপসর্গ ছিল এবং তাদের পরীক্ষার দরকার ছিল। তারা আতঙ্কিত হয়েই ফোন করেছেন। সক্ষমতা না থাকায় তাদের সবার পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এদের মধ্যে উপসর্গযুক্ত রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হলে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ লোকের করোনা পজেটিভ পাওয়া যেত।
অর্থাৎ আরও ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ করোনা পজেটিভ হিসেবে চিহ্নিত হতো। এদের যথাযথভাবে আইসোলেশনে রাখা যেত, তবে সংক্রমণ অনেক কম হতো। একই সঙ্গে দ্রুত করোনা নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হতো। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত বুলেটিনে ঘোষণা দেয়া হয় সর্বশেষ একদিনে সুস্থ হয়েছেন ১৫ হাজার ২৯৭ জন।
এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যারা সুস্থ হয়েছেন তাদের মধ্যে শুধু হাসপাতালের সুস্থতা নয়। বাসায় এবং যারা উপসর্গবিহীন ছিলেন, সবাই এর সঙ্গে যোগ হয়েছেন। এই তথ্য আইইডিসিআর সরবরাহ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, একইভাবে উপসর্গহীন এবং উপসর্গ নিয়ে যারা মারা যাচ্ছেন বা অসুস্থাবস্থায় আছেন পরীক্ষা করাতে পারছেন না তাদেরও সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে যোগ করা উচিত। এতে শনাক্তদের আলাদা করে রাখা সম্ভব হবে। কমবে সামাজিক ও পারিবারিক সংক্রমণ।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, উপসর্গ ছিল এমন লোকেরাই অধিদফতরের হট নম্বরে ফোন করেছেন। তাই এদের উপসর্গযুক্ত রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে প্রায় ৬০টি ল্যাবে পরীক্ষা চলছে। অর্থাৎ এ পর্যায়ে গড়ে দৈনিক ২০ হাজার মানুষের পরীক্ষা করা সম্ভব।
তাছাড়া রোববার পরীক্ষাকৃত নমুনায় ২১ দশমিক ৬ ভাগ পজেটিভ কেস শনাক্ত হচ্ছে। এই হিসাবে বলাই যায় যাদের উপসর্গ ছিল তাদের মধ্যে ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ কোভিড-১৯ পজেটিভ। করোনার ভয়াবহতার হাত থেকে দেশের মানুষদের রক্ষা করতে অবিলম্বে জোনভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ৬০টি ল্যাবে পরীক্ষা চলছে, যার ৩০টিই ঢাকায় এবং ১৭টি ল্যাব সাতটি জেলায়। ২০টি জেলায় ল্যাব স্থাপন হলেও ৪৪টি জেলায় কোনো ল্যাব স্থাপন করা হয়নি। ল্যাবের অভাবে এখনও বিপুলসংখ্যক মানুষ রয়ে যাচ্ছেন পরীক্ষার বাইরে। এদের বেশির ভাগ সন্দেহভাজন করোনা রোগী। যাদের শরীরে করোনাভাইরাসের কোনো না কোনো উপসর্গ দেখা দেয়ায় সার্বিক সহযোগিতা প্রত্যাশায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের হট নম্বরগুলোতে ফোন করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মার্চ মাস থেকে দেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষা শুরু করা হয়। তখন মাত্র একটি ল্যাবে দিনে গড়ে একশ’ থেকে দু’শ নমুনা পরীক্ষা করা হতো। এপ্রিল মাসে গিয়ে আরও চার-পাঁচটি ল্যাবে পরীক্ষা শুরু হয়। কিন্তু রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকায় এরপর ল্যাবের সংখ্যা বাড়াতে শুরু করে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
এপ্রিলের শেষে ল্যাবের সংখ্যা প্রায় ২০টিতে উন্নীত হয় এবং মে মাসে এটি ৫০টিতে পৌঁছায়। বর্তমানে ৬০টি ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে। তবে এর ৩০টিই ঢাকায় অবস্থিত। বাকি ৩০টির মধ্যে চট্টগ্রামে পাঁচটি, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নোয়াখালী, বগুড়া, সিলেট, রাজশাহীতে দুটি করে ল্যাব রয়েছে। এছাড়া কুমিল্লা, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, কিশোরগঞ্জ এবং ফরিদপুরে একটি করে ল্যাব চালু রয়েছে। বাকি ৪৪ জেলায় এখনও কোনো ল্যাব স্থাপন করা হয়নি।
ভাইরাসবিদদের মতে, করোনাভাইরাসের মতো ভয়াবহ সংক্রামক ভাইরাস এক জেলা থেকে আরেক জেলায় নিয়ে পরীক্ষা করা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি কষ্টসাধ্য। অনেক দুর্গম উপজেলা বা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নমুনা সংগ্রহ করাও সম্ভব নয়। তাছাড়া সঠিক নিয়মে সংরক্ষণ করা সম্ভব না হলে সেটির পরীক্ষায় সঠিক ফলাফল পাওয়া যায় না।
অধিদফতরের তথ্যে দেখা যায়, দেশে করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন হট নম্বরে ফোন কল এসেছে এক কোটি ১১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩২টি। এর মধ্যে স্বাস্থ্য বাতায়নে (১৬২৬৩) নম্বরে কল এসেছে ৫২ লাখ সাত হাজার ৯৬০টি, ৩৩৩ নম্বরে কল এসেছে ৫৬ লাখ ৬৯ হাজার ৫৩৩ জন এবং আইইডিসিআর (১০৬৫৫; ০১৯৪৪৩৩৩২২২) এর নম্বরগুলোতে কল এসেছে দুই লাখ ৬৮ হাজার ১৩৯টি। এছাড়া এ পর্যন্ত দেশের বিমান/সমুদ্র/স্থলবন্দর ও রেলস্টেশন দিয়ে মোট সাত লাখ ১৮ হাজার ২৩৯ জন যাত্রী দেশে প্রবেশ করেছেন। অথচ এই যাত্রীরাও রয়ে গেছেন পরীক্ষার বাইরে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, ৬৪টি জেলায় পিসিআর ল্যাব করার বাস্তবতা না থাকলেও যেসব জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ রয়েছে সেখানে ল্যাব স্থাপন ও নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা এখনও নেয়া হয়নি।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্তের ঘোষণা আসে। গত ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে করোনা পজেটিভ রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এরই মধ্যে মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। করোনা উপসর্গ নিয়ে যাদের মৃত্যু হচ্ছে বা যারা উপসর্গ থাকার পরও পরীক্ষা করাচ্ছেন না, তাদের অনেকের হিসাবই এর বাইরে। এভাবে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে সংক্রমণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া না হলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।
দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার একশতম দিনে সোমবার আক্রান্তের সংখ্যা ৯০ হাজার ছাড়িয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এই সংখ্যা এক লাখ অতিক্রম করবে। এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে দীর্ঘ ৫০ দিন পর শনিবার আবার দু’জন কোভিড-১৯ পজেটিভ রোগী পাওয়া গেছে।
তাদের হিস্ট্রি নিয়ে জানা গেছে তারা সম্প্রতি বেইজিংয়ের সবচেয়ে বড় পাইকারি কাঁচাবাজারে গিয়েছিলেন। তারপর প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢরহভধফর নামক সেই বাজারের আশপাশের ১১টি এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, সেনা পুলিশ টহল শুরু হয়েছে, গণপরিবহন এবং স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দু’জনের কন্টাক্ট ট্রেসিং করে ইতোমধ্যে ৫১৭ জনের পিসিআর করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ৪৫ জনের কোভিড-১৯ পজেটিভ এসেছে (সবাই লক্ষণহীন)।
ওই বাজারে কর্মরত ১০ হাজার কর্মীর টেস্ট করার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এরপর গত কয়েক দিনে যত মানুষ ওই বাজারে গেছে, তাদের সবার টেস্ট করা হবে। তিনি বলেন, আমরা বর্তমানে প্রথম সংক্রমণের ধাক্কাতেই বেসামাল। তবে মহামারীর যে কোনো পর্যায়ে সংক্রমণ ঠেকাতে কিছু মৌলিক কাজ করতেই হবে। যেমনটা চীনসহ অনেক দেশই করছে।
তিনি বলেন, ছোট বড় কোনো এলাকাই লকডাউন করে লাভ হবে না, যদি সেই এলাকার প্রতিটি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত না করা যায়, আক্রান্তদের আইসোলেট না করা যায়। এতে কেবল মানুষের দুর্ভোগই বাড়বে, ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা আমাদের সাধ্যমতো পরীক্ষার আওতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। বর্তমানে ৬০ ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে। লোকবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আশা করি অবিলম্বে পরীক্ষার হার আরও বাড়বে।