২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে আফ্রিকান-আমেরিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড পুলিশের হত্যার শিকার হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে সামারিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে দেশটিকে।
বস্তুত, ৯ দিনের টানা প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে সাম্প্রতিক ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্রান্তিকাল বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। একদিকে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও দাবি-দাওয়া, অন্যদিকে ক্ষমতার দাপট ও দমনের উদ্যোগ সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করেছে। অনেকের প্রশ্ন, হঠাৎ করে এমন বিক্ষোভ-প্রতিবাদ কেন?
মূলত এমন ঘটনা- আফ্রিকান-আমেরিকান, কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য সংখ্যালঘু বর্ণের মানুষকে হত্যার ঘটনা- যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়ই ঘটে থাকে। কিন্তু জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার পর পরিস্থিতি খারাপ হওয়া এবং তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পেছনে আমি অনেক কারণ দেখি। এর সঙ্গে আরও অনেক প্রশ্নও সামনে আসছে।
এটা কতদিন চলবে; প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সম্পর্কে ট্রাম্পের দাবি ও আগামী নির্বাচনে এটি কী ধরনের প্রভাব ফেলবে- এমন অনেক প্রশ্ন আসছে বিশ্লেষকদের পক্ষ থেকে।
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব দরবারে আমেরিকার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের ক্ষমতার নৈতিকতার ঘাটতি দেখা গেলেও এখনও মানবিক শাসন ও মানবতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই শীর্ষে রয়েছে। এটাও বলে রাখা দরকার, অনেকের কাছে স্বপ্নের দেশ আমেরিকা।
এতকিছুর পরও বাস্তবতা হল আমেরিকান সমাজ মানুষেরই গড়া। সেখানে রাগ-অভিমান, ক্ষোভ, বর্ণবাদ, বৈষম্য ইত্যাদিও বিদ্যমান রয়েছে। তবে আমেরিকার সমাজে এতকিছুর পরও ব্যতিক্রমী একটি জিনিস আমরা দেখছি- তা হল সেখানে প্রতিবাদের সুযোগ রয়েছে।
প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ইত্যাদির পর পর্যালোচনা করে ভালো বিষয়টি গ্রহণের মানসিকতাও তাদের রয়েছে। আমার ধারণা, এখনও এ কারণেই যে কোনো ঘটনা, আলোচনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে আমরা আমেরিকার দিকে মনোযোগী হই।
বর্তমানে সেখানে যে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চলছে, সেটি হঠাৎ কোনো বিষয় নয়। এখানে অনেকগুলো বিষয় আছে। ৫০ বছর ধরে কালোদের অধিকার, তাদের বঞ্চনা নিয়ে কথা হচ্ছে। আইন হওয়ার পরও সমঅধিকারপ্রাপ্তি ও বৈষম্যহীন আচরণের অগ্রগতি তারা দেখেনি। বরং বর্ণবৈষম্য প্রশাসন, সমাজ ও রাজনীতিতেও জেঁকে বসেছে।
এ কারণেই আমরা দেখি, গত ছয় বছরে ৭ হাজার ৬শ’র বেশি কৃষ্ণাঙ্গ নিগৃহিত হয়েছে। ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত হয়েছে। এখন যেটা হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হচ্ছে।
বিভিন্নভাবে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। আমার ধারণা, কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য অশ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের দমনপীড়নে পুলিশকে উসকানি দেয়া হচ্ছে। জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার ক্ষেত্রে যেমনটি আমরা দেখলাম, একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের হত্যাকাণ্ড।
আমেরিকার সমাজে এখনও বর্ণবাদের রেশ রয়েছে, যা অশ্বেতাঙ্গ মানুষের ক্ষোভের কারণ। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ ১৪ শতাংশ। এর বাইরে অন্যান্য অশ্বেতাঙ্গ জাতিগোষ্ঠী নিয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষ। এরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অধিকারবঞ্চিত। এত মানুষ যদি বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ হয়, তবে সেটা কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই স্বস্তির নয়।
আরেকটি কারণ হল, ১৯৮০-এর দশকের পর থেকে নব্য পুঁজিবাদ তথা নব্য উদারবাদের উত্থান। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বৈষম্য ক্রমপ্রসারমান। এতে অশ্বেতাঙ্গ যারা, তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। শ্বেতাঙ্গরাও আছে পিছিয়ে পড়ার তালিকায়। তবে সেটা কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য অশ্বেতাঙ্গের তুলনায় কম।
সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে- ৪০ শতাংশ বাড়িতে নগদ ৪শ’ ডলার নেই। বেশিরভাগ মানুষ ঋণগ্রস্ত। এর কারণ নব্যপুঁজিবাদী ব্যবস্থা। ২০০৭-০৮ সালের মন্দার ধাক্কা তারা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এক্ষেত্রে অশ্বেতাঙ্গদের অবস্থা বেশি শোচনীয়।
আমার মনে হয়, স্বপ্নের দেশ হিসেবে পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশের মানুষ এটা মেনে নিতে পারেনি। জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ এর প্রতিফলন। বিক্ষোভকারীরা যে সুষম বণ্টনের দাবি করছে, তা থেকেও বিষয়টি অনুমান করা যায়।
আরেকটি কারণ হতে পারে করোনাভাইরাসের কারণে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি। করোনায় মারা যাওয়া লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে ৪০ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ। এরা প্রান্তিক ও বঞ্চিত হওয়ায় ভালো স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত থেকে কোভিড-১৯-এর বেশি শিকার। এছাড়া স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও তাদের বঞ্চিত থাকার হার অনেক বেশি। এটিও তাদের করোনায় আক্রান্তের হার বাড়িয়েছে।
এর বাইরে জাতিগোষ্ঠীর অস্থিরতাও বর্তমানে আমেরিকার প্রতিবাদ-বিক্ষোভের অন্যতম কারণ। করোনাভাইরাসের কারণে ৪ কোটির বেশি মানুষ আমেরিকায় বেকার হয়েছে। বেকার সব দেশেই হয়েছে, আমাদের দেশেও আছে। কিন্তু তাদের ডাইমেনশন ভিন্ন। কাজ না থাকলে তারা বীমা পায় না, বাড়ির মর্টগেজ দিতে পারে না।
এতে করে তাদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে। বিশেষত তরুণরা বেশি হতাশ। আমার ধারণা, এসব পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে বর্তমান বিক্ষোভ সহিংসতা ও লুটপাটে রূপ নিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একে কিভাবে নিচ্ছেন, সেটি একটি বিষয়। তার কৌশল কী? তিনি প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে সন্ত্রাসবাদ বলছেন, এটি বাস্তবসম্মত নয়। এটা সত্য, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ থেকে লুটপাট হয়েছে; কিন্তু প্রতিবাদকারীরাই এতে প্রত্যাখ্যানও করেছেন।
ট্রাম্প মূলত বিভক্তি বাড়াচ্ছেন, তিনি সামরিক বাহিনী পাঠানোর হুমকি দিয়েছেন। তবে এটি তার স্বভাবসুলভ বাড়াবাড়িই বলা যায়। কারণ তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী- যারা দু’জনই বর্তমান ও সাবেক জেনারেল, তারা ট্রাম্পের বলপ্রয়োগের চিন্তা বাতিল করে দিয়েছেন।
সুধীজনের ধারণা, অতি বলপ্রয়োগে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এটি আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো হিতে বিপরীত হতে পারে। আমার মনে হয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে দ্রুত। কারণ বুধবার মিনেসোটার অ্যাটর্নি জেনারেল পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেফতাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত হত্যা ও বাকিদের বিরুদ্ধে হত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে বিক্ষোভ খানিকটা স্তিমিত হবে। কিন্তু সমঅধিকার, বৈষম্য, বর্ণবাদ ইত্যাদি ইস্যু অনুরণিত হবে।
সামনের দিনগুলোর কথা বিবেচনায় নিলে সবার সমবিচারের দাবি, বৈষম্যবিরোধী ডাক, বর্ণবৈষম্য নিরোধ এবং স্বাস্থ্যবীমা তথা ওবামাকেয়ার- এগুলো আলোচনায় থেকে যাবে।
আপাতদৃষ্টিতে স্তিমিত হলেও আগামী নির্বাচনে এগুলো ঘুরেফিরে আসবে। সম্ভাব্য ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন এরই মধ্যে গুলি নিয়ন্ত্রণ, ওবামাকেয়ার ও বর্ণবাদবিরোধী উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেছেন। ছাত্রদের ঋণ মওকুফ করার কথাও তিনি বলেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার খরচ অনেক এবং ছাত্রদের ঋণ করে পড়াশোনা করতে হয়। এগুলোর ওপর জোর দিয়ে যদি বাইডেন অগ্রসর হন, তবে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।
কারণ ট্রাম্প যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে তার রেটিং কমেছে। ট্রাম্পের ঘৃণা নাকি বিপরীতে ভালোবাসা- সেটা দেখা যাবে আগামী দিনে। আমি আন্দাজ করছি, একটা রোডম্যাপ নিয়ে এগোনো গেলে গোটা বিশ্বের মানুষের স্বপ্ন, আমেরিকার স্বপ্ন ইতিবাচক মোড় নেবে।