হারুন অর রশিদ, Prabartan | প্রকাশিতঃ ১১:২৭, ০৬-০৫-১৯
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাফিলতি আর বাঁধ নির্মাণকারী ঠিকাদারদের দুর্নীতির কারণে খুলনার কয়রা উপজেলার তিন লাখ মানুষ বছরের পর বছর আতংক আর উৎকন্ঠা নিয়ে দিন কাটায়। ঠিকাদারেরা বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের দায়িত্ব পেয়ে তা সময়মতো ও সঠিকভাবে শেষ করেন না। ফলে বেড়ি বাঁধগুলো একে একে ভেঙে বার বার বিপর্যয় ঘটে।
- অসময়ে কাজ শুরু করা
- অদক্ষ শ্রমিকদের কাছে ঠিকাদারের কাজ বিক্রি
- বেশি লাভের আশায় ঢালের মাটি কেটে বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো
- ঠিদাদারের সাথে পাউবো কর্মকর্তাদের সখ্যতা
‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের টাকা পানিতেই যায়’ এই জনশ্রুতির যথার্থতা প্রমাণের জন্য হয়তো বাঁধের কাজ সময়মত শুরু না করে বর্ষা মৌসুমের অপেক্ষায় থাকে পাউবো। বর্ষার পানি আসার পর কাজ শুরু করলে বাঁধ নির্মাণের মাটি পানিতেই ভেসে যাবে। তখন কত কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে, তার কোনো সঠিক হিসাব থাকবে না। তিন কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করে ৩০ কিলোমিটারের অর্থ লোপাট করা যাবে। পাঁচ ফুট উঁচু বাঁধ করার নিয়ম থাকলেও তখন তাড়াহুড়া করে করা হবে এক থেকে দুই ফুট। মূলত পাউবো কর্তৃপক্ষের অর্থ লোপাট করার এমন ফন্দিফিকিরই উপকূলীয় এলাকায় বিপর্যায়ের অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বসীলদের দাবী, অর্থ ছাড় না হওয়ায় সময়মতো বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারেন না তারা। গত বছরও বর্ষার আগ মূহুর্তে কয়রা উপজেলার কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এলাকার মানুষ। ঠিক তখন অন্যদিকে চলছিল পাউবোর বাঁধ নির্মাণের কাজ। ফলে বাঁধ নির্মাণের অর্থ পানিতেই ভেসে যায়। এলাকাবাসির কোনো উপকারে আসেনি।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, যেটুকু কাজ হয় তার বেশিরভাগই দায়সারাভাবে হয়। কোনোরকমে অল্প মাটি ফেলা হয়। অনেক স্থানে বাঁধের ঢালের মাটি কেটে বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো হয়। বরাদ্দের ২০ ভাগ অর্থও বাঁধ সংস্কারে ব্যয় হয়না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। যে কারণে নদীর পানি বাড়ার সাথে প্রতি বছর এলাকার মানুষকে বাঁধ ভাঙা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দূর্যোগ ফণি’র প্রভাবে ১০ কিলোমটার বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এলাকার মানুষ সেখানে দিন রাত পরিশ্রম করে কোন রকমে টিকিয়ে রেখেছেন। তবে বর্ষা মৌসুমে বড় বিপর্যায়ের আশংকা রয়ে গেছে।
কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস,এম শফিকুল ইসলাম বলেন, পাউবো’র নিয়োজিত ঠিকাদার কাজ পেয়েই পাউবো’র স্থানীয় দায়িত্বসীল কর্মকর্তাদের সাথে যোগ সাজসে তা অর্ধেক দামে শ্রমিক সরদারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। শ্রমিক সরদাররা আবার ওই কাজ আরও কম দামে শ্রমিকদের চুক্তি করে দেয়। ফলে বাঁধ মেরামতের মূল বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ কাজের আগেই লুটপাট হয়ে যায়। এছাড়া শুকনা মৌসুমের কাজ শ্রমিকরা বর্ষা মৌসুমের আগ মূহুর্তে তড়িঘড়ি সম্পন্ন করে চলে যায়। সে সময় কাজ তদারকি কিংবা তা বুঝে নেওয়ার মত সময় থাকেনা। তারা কাজের কোন ফিলিং চার্টও জনসমক্ষে আনতে চায় না।
তিনি পাউবো’র নিয়োজিত ঠিকাদারদের কাজের সাইটে সাইনবোর্ড স্থাপন করে সেখানে কাজের যাবতীয় তথ্যাদি উপস্থাপনের দাবী জানিয়ে বলেন, এতে স্থানীয় মানুষ বেড়ি বাঁধের কাজ বুঝে নিতে পারবে। সেই সাথে কাজের দূর্নীতিও অনেকাংশে কমে আসবে।
পাউবো সূত্র জানায়, চলতি বছর কয়রা উপজেলায় ১ কোটি টাকা বরাদ্দে ১২টি গ্রুপে ২ কিলোমিটারের মত বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে এ ১২টি গ্রুপের কাজ ঠিকাদাররা স্থানীয় শ্রমিক সরদারদের কাছে অর্ধেক টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। প্রত্যন্ত এলাকায় চলমান এ কাজ তদারকি করারও কেউ নেই বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অভিযোগ করেন। কয়রা উপজেলার উত্তরবেদকাশি ইউনিয়নের ইউপি সদস্য গনেষ মন্ডল অভিযোগ করেন, এলাকার একজন চিহ্নিত শ্রমিক সরদার পাউবো’র সব কাজ নিয়ন্ত্রন করে থাকে। গত বছর সংস্কার কাজ চলমান অবস্থায় বাঁধ ভেঙে দেওয়ার অভিযোগে ওই শ্রমিক সরদারসহ পাউবো’র কর্মকর্তা জনারোষের শিকার হয়। এবারও ওই শ্রমিক সরদার কাজ নিয়ন্ত্রন করছে।
পাউবো’র উপ-সহকারি প্রকৌশলী মশিউল আবেদীন জানান, আগে থেকেই কয়রা উপজেলার দক্ষিণবেদকাশি, উত্তরবেদকাশি, কয়রা সদর, মহেশ্বরীপুর ও মহারাজপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি স্থানে বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বরাদ্দের অভাবে এসব বাঁধ সময়মত সংস্কার সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যে কারনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ফণির প্রভাবে ওইসব স্থান আরও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ মেরামতের জন্য জরুরী ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
পাউবো’র সাতক্ষিরা-২ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আরিফুজ্জামান বলেন, কয়রা উপজেলায় পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর দপ্তর রয়েছে। সেটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় সেখানে সার্বক্ষনিক কর্মকর্তা ও প্রয়োজনীয় জনবল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে সার্বক্ষনিক নজরদারি অথবা তদারকি সম্ভব হয়ে ওঠে না। ক্ষতিগ্রস্থ বাধ রক্ষণাবেক্ষণ অথবা মেরামতের পর বাঁধের তদারকির দরকার আছে।
তিনি আরও বলেন, সাতক্ষিরা থেকে কয়রা উপজেলার দুরুত্ব বিবেচনায় তা সম্ভব হয় না। এসব কারণে ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধগুলি সময়মত সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহন করতে না পারায় এলাকাবাসির বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাঁধের কাজে দূর্নীতির প্রসংগে তিনি বলেন, আগে কি হয়েছে জানিনা, তবে আমি এখানে যোগদানের পর সংশ্লিষ্ট সকলকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছি।