আওয়াল শেখ, Prabartan | আপডেট: ২২:২৯, ০৪-০৪-১৯
নির্মাণ শৈলির চমৎকার স্থাপনার এক অনন্য নিদর্শন রয়েছে খুলনাঞ্চলের প্রাচীন মসজিদগুলোতে। কালের বিবর্তনে আজও এই পূরাকৃতিগুলো দাঁড়িয়ে আছে পুরনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। মিনার, গম্বুজ ও নানা নকশার ভিত্তিতে নান্দনিক মসজিদগুলোর ঐতিহাসিক পরিচিতি রয়েছে বেশ। সময়ের সাথে ঐতিহ্য ধরে রাখতে খুলনাঞ্চলের নতুন মসজিদগুলো ও তৈরি হচ্ছে নান্দনিক শিল্প কৌশলে।
বর্তমানে খুলনা জেলায় এক হাজার ৩৭৪টি মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যের রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন মসজিদ। বিশেষ করে মসজিদকুড় মসজিদ, আরশ নগরের মসজিদ, বেদকাশী মসজিদ, সোলায়মান পুরের মসজিদ, আলাইপুরের মসজিদ, চিংড়া মসজিদ, টাউন জামে মসজিদ, টুটপাড়া জামে মসজিদ উল্লেখযোগ্য। আবার বর্তমান সময়ে যেসব মসজিদ তৈরি হয়েছে সেগুলোরও নির্মাণ কৌশল খুবই চমৎকার। এর মধ্যে খুলনা মহানগরীর বাইতুন নুর মসজিদ কমপ্লেক্স, তালাবওয়ালা জামে মসজিদ (দারুল উলুম মাদ্রাসার মসজিদ), নিরালা প্রধান জামে মসজিদ ও সোনাডাঙ্গা আবাসিক জামে মসজিদ উল্লেখযোগ্য।
ইতিহাসের আলোকে বিচার করলে দেখা যায়, সামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৩১০-১৩২৫) প্রথম খুলনা আগমন করেন। সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সময়ে (১৩৪২-১৩৫৮) খুলনা অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটে। তারপর হযরত খান জাহান আলী (রঃ) এ অঞ্চলে মুসলিম শাসন চালু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহত্তর খুলনা জেলায় শ’ শ’ বছর আগে ইসলাম প্রচারক ও মুসলিম শাসক কর্তাদের আগমনের সাথে সাথে তাঁরা অনেক মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তবে খুলনা জেলায় এ ধরণের কতটি প্রাচীন মসজিদ ছিল তার সঠিক হিসেব পাওয়া যায়নি। বেশ কিছু সংখ্যক প্রাচীন মসজিদ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিলীন হয়ে গেছে। কালের সাথে যুদ্ধ করে যে সব প্রাচীন মসজিদ টিকে আছে এবং বর্তমান সময়ে গড়ে ওঠা দৃষ্টিনন্দন মসজিদগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণী তুলে ধরা হল:
মসজিদকুড় মসজিদ : খুলনা মহানগরী থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে কয়রা উপজেলায় আমাদী গ্রামে মসজিদকুড় মসজিদ অবস্থিত। এটি নির্মাণ করেছিলেন হযরত খানজাহান আলীর (রঃ) একান্ত সহচর হযরত বুড়ো খাঁ (রঃ)। তিনি ধর্ম প্রচারের সাথে রাজ্য শাসন ও জমি পত্তন করতেন। মসজিদটি সুন্দরবন অঞ্চলের অবিস্মরণীয় কীর্তি। এটি বর্গাকার। এর প্রত্যেক বাহুর দিকে ৫৪ ফুট ও ভিতরের দিকে ৪০ ফুট লম্বা। মসজিদের তিনটি প্রবেশপথ আছে। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মেহরাব। আছে চারটি মিনার। মসজিদটির বাইরের দেয়ালে দক্ষিণ পূর্ব ও উত্তর দিকে পোড়া মাটির চিত্র ফলকের দ্বারা অংকিত ছিল। মসজিদের মধ্যে ৪টি প্রস্তর স্তম্ভ আছে। আরো আছে ৯টি গম্বুজ। গম্বুজের নির্মাণ কৌশল খুবই চমৎকার।
আরশ নগরের মসজিদ : খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার আরশনগর গ্রামে একটি মসজিদ আছে। মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল ইংরেজি ১৫০০ সালে। যতদূর জানা যায়, এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন পিরে কামেল শেখ শাহ আফজাল (রঃ) তিনি হযরত খানজাহান আলীর (রঃ) সাথে ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন। এক পর্যায়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মসজিদটি ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়। ১৯৮৩ সালে ধ্বংস স্তুপ থেকে মসজিদটি উদ্ধার করে সংস্কার করা হয়। মসজিদের ভিতর থেকে একটি শিলা লিপি উদ্ধার করা হয়। তাতে একটি হাদিস লেখা আছে। বর্তমানে শিলা লিপিখানি রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত আছে।
বেদকাশী মসজিদ : কয়রা উপজেলায় বেদকাশি গ্রামে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল হযরত খানজাহান আলীর (রঃ) সময়ে। এটি নির্মাণ করেছিলেন তার একান্ত সহচর হযরত খালেক খাঁ (রঃ) মসজিদটি কারুকার্য খচিত করে নির্মাণ করা হয়েছিল।
সোলায়মানপুরের মসজিদ : পাইকগাছা উপজেলায় সোলায়মানপুর গ্রামে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল হযরত খানজাহান আলীর (রঃ) আমলে। এটি নির্মাণ করেছিলেন তার সাথে আসা এক শিষ্য হযরত বোরহান উদ্দিন খান (রঃ)।
আলাইপুরের মসজিদ : রূপসা উপজেলার আলাইপুরে একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। মসজিদটি দেখতে খুবই চমৎকার। তবে মসজিদটি কে নির্মাণ করেছিলেন তার সঠিক ইতিহাস এখনো অনুদঘাটিত। তবে এটি খানজাহান আলীর (রঃ) সময় নির্মিত হয়েছে বলে বিজ্ঞজনেরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
চিংড়া মসজিদ : ডুমুরিয়া উপজেলার চিংড়া গ্রামে একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। মসজিদটি কে নির্মাণ করেছেন তার সঠিক তথ্য জানা যায় না। অনেকের ধারণা এ মসজিদটিও খানজাহান আলীর (র.) সময়ে নির্মিত হয়েছিল। এ মসজিদ নিয়ে অনেক অলৌকিক কথা শোনা যায়।
টাউন জামে মসজিদ : খুলনা মহানগরীর পুরানো মসজিদ টাউন জামে মসজিদ। এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৫৪ সালে। এটি ভৈরব নদের পাড়ে কেডি ঘোষ রোডের পূর্ব দিকে অবস্থিত। শুরু থেকেই আজ পর্যন্ত মসজিদটিতে বহু মুসল্লির সমাগম ঘটে।
টুটপাড়া জামে মসজিদ : নগরীর টুটপাড়া বড় পুরানো জামে মসজিদটি ১৮৮০ সালে নির্মিত হয়।
বায়তুন নূর মসজিদ : নগরীর সবচেয়ে আধুনিক মসজিদ হচ্ছে বায়তুন নূর মসজিদ কমপ্লেক্স। মসজিদটি ১৯৮০ সালের ২২ নবেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলামকে সভাপতি করে এই মসজিদ নির্মাণের প্রথম কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.এস. এম মোস্তাফিজুর রহমান মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ মসজিদে এক সাথে ৬ হাজার মুসল্লি নামায আদায় করতে পারেন। মহিলাদের জন্যও মসজিদটিতে আছে আলাদা নামাযের স্থান। এছাড়া মসজিদটির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় আছে মাদরাসা ও ইসলামী পাঠাগার। মসজিদটির মিনার ১৩৮ফুট উচ্চতা।
তালাবওয়ালা জামে মসজিদ: নগরীর প্রাণকেন্দ্রে ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জামি’আ ইসলামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসা’। মাদ্রাসার মসজিদটির নাম তালাবওয়ালা জামে মসজিদ (পুরাতন তাবলিম মসজিদ)। আর এ মসজিদটিতে রয়েছে খুলনা বিভাগের সর্বোচ্চ সুউচ্চ মিনার। মিনারটির উচ্চতা ২২৬ ফুট। মসজিদ ও মিনারটির পুরোটাই সাদা টাইলস দিয়ে তৈরি। মসজিদটিতে ৪টি গম্বুজ ও একটি মিনার রয়েছে। মিনার থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসলে মুসল্লিরা ইবাদত বন্দেগীর নূরাণী জগতে প্রবেশ করতে ছুটে আসেন তালাবওয়ালা জামে মসজিদে। দূর দূরান্ত থেকে এ মিনারটি দেখতে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন। মসজিদের তিন পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় সর্বোচ্চ এবং অন্যতম সুন্দর মিনার দেখে মুগ্ধ হন সবাই।
এছাড়া বর্তমানে খুলনা মহনগরীতে ময়লাপোতার মোড়ে নির্মত বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদ দুটি আধুনিকভাবে নির্মিত হচ্ছে। তবে ময়লাপোতা মোড়ে নির্মিত মসজিদটির নীচ তলায় মার্কেট নির্মান মসজিদটির সৌন্দর্য্যে ব্যত্যয় ঘটাবে বলে মনে করছেন নগরবাসি।