এম সাইফুল ইসলাম, Prabartan | আপডেট: ০২:৩০, ২১-০৩-১৯
খুলনা মহানগরীতে নতুন করে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে আটটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি। শুধু সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই চলছে এ ব্যবসা।
আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার স্বপ্নে প্রতারিত হচ্ছে উঠতি বয়সী তরুণরা। বন্ধ হওয়ার পর ডেসটিনি, ইউনিপে টু ইউসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কথিত পিএসডি ও ডায়মন্ডরাই পেছনে থেকে নতুনভাবে এসব ব্যবসা পরিচালনা করছেন-এমন অভিযোগ নগরীর সাধারণ মানুষের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীতে বর্তমানে ৮টি এমএলএম প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। সেগুলো হলো, ওয়ার্ল্ড মিশন-২১, স্বাধীন অন লাইন বাজার, রিচ বাজার, আমার বাজার, সেবা অনলাইন, টিয়ানসি, একসিলেন্ট ফিউচার মার্কেটিং ও ইটিউব গ্লোবাল।
- টার্গেট করা হচ্ছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের
- অল্প সময়ে লাখপতি হওয়ার প্রলোভন
- যে কোনো সময় গা ঢাকা দিতে পারে একাধিক প্রতিষ্ঠান
২০১২ সালে এমএলএম কোম্পানী ডেসটিনির অনিয়ম ধরা পড়লে তা বন্ধ করে দেয় সরকার। এরপর ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রণয়ন করা হয় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন। এই আইনের অধীনে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা হয় বিধিমালা, যা আবার সংশোধন করা হয় ওই বছরেরই ২২ জুলাই।
সরকারি তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, লাইসেন্স ছাড়া এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করা জামিন অযোগ্য অপরাধ। এতে লাইসেন্স ছাড়া কেউ এই ব্যবসা করলে ও প্রতারণা করে থাকলে কাছাকাছি থানা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করতে সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানায় সরকার।
তবে নগরীতে চালু থাকা এমএলএম কোম্পানীগুলো সরকারি যেসব বিধিমালা অনুসরণ করা প্রয়োজন তার কোনো শর্তই পূরণ করেনি। তারা অনেকটা গোপনে এবং কৌশলে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কোম্পানীর প্রধান টার্গেট স্কুল কলেজ পড়–য়া তরুণ তরুনী ও গৃহীনিরা। কোম্পানীর সঙ্গে জড়িতরা নানান প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে মানুষকে আকৃষ্ট করছে।
নগরীর নিউ মার্কেট ওয়েস্টার্ন প্লাজায় ওয়ার্ল্ড মিশন-২১ নামে একটি কোম্পানিতে গিয়ে দেখা যায় নিত্যপণ্যের একটি দোকান। পাশে রয়েছে উন্মুক্ত জায়গা যেখানে কোম্পানির গ্রাহক ও গ্রাহক হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কোম্পানির প্লান দেখানো হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ২০১৭ সালে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে খালিদ হাসান, ফয়সাল ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা এম মাসুদকে আটক করে।
অভিযোগ অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ইলেক্ট্রনিকস কোম্পানির নামে পদ্ধতিগত কিছুটা ভিন্নতা দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতে। আগ্রহীদের প্রতিমাসে ১৫ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা আয়ের প্রলোভনে এ ব্যবসায় সম্পৃক্ত করা হচ্ছিল। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযান চালিয়ে এমএলএম ব্যবসার অনুমোদিত কাগজপত্র না থাকায় ৩ জনকে আটক করা হয়।
এই প্রতিবেদক কোম্পানীতে যোগদান করার কথা বলে তাদের অফিসে গেলে কলেজ ছাত্র সোলায়মান নিয়ে যায় তার ডেস্কে। প্রতি ডেস্কে একজন কর্মকর্তা ও ৪-৫ জন তরুণ তরুণীকে দেখা যায়। সবাই আগ্রহ নিয়ে প্লান দেখছে। সোলায়মান বলেন, মানুষের আয়ের তিনটি উৎস। চাকরি ব্যাবসা বা বিদেশ যাওয়া। কিন্তু এই তিনটির কোন নিশ্চয়তা নেই আর সেখানে ওয়ার্ল্ড মিশনের সাড়ে ছয় হাজার টাকার পণ্য কিনে আয় করতে পারবেন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাক।
তিনি আরো বলেন, আপনি একটি ১০০ পয়েন্টের পণ্য ক্রয় করলেই পেয়ে যাবেন ৬ শ টাকা কমিশন। আরো দুইজন আপনার মাধ্যমে পন্য কিনলে আপনি পাবেন আরও এক হাজার ২ শ টাকা। এভাবে মাসে ২১ হাজার টাকা থেকে লক্ষাধিক টাকা আয় করা সম্ভব বলে সে জানায়। ২০১৬ সালে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে প্রতারণার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তা আটক ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এরপর কিছু দিন কার্যক্রম থেমে থাকে। পরে আবারও চালু হয়।
নগরীর সিদ্দিকিয়া মাদ্রাসার ছাত্র মনির মাদ্রাসার হোস্টেলে তিন মাসের টাকা বাকি রেখে ওয়ার্ল্ড মিশন-২১ থেকে পণ্য কিনে যোগদান করে। যোগাদানের এক বছরেও সে কোন টাকা আয় করতে পারেনি। উল্টো মাদ্রাসায় টাকা না দেয়ায় তাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেয় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে ওয়ার্ল্ড মিশন-২১ এর খুলনা অফিসের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মোঃ খালিদ হাসান বলেন, ‘২০১৩ সালে সরকার যে চারটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসার জন্য লাইসেন্স প্রদান করেন আমাদের প্রতিষ্ঠান তার মধ্যে একটি। মেয়াদ শেষে নবায়নের জন্য আবেদন করলে তা গ্রহন করা হয়নি। সরকার লাইসেন্স না দেয়ায় হাইকোর্টে রিট করা হয়। হাইকোর্ট বাদী এবং বিবাদী উভয় পক্ষের স্থিতাবস্থা জারি করে- যার ফলে বর্তমানে এ ব্যবসা করতে কোনো বাধা নেই।’
এমএলএম নীতিমালার ১৫নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে- ‘এমএলএম পরিচালনায় পিরামিড সদৃশ বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। অবস্তুগত বা অলিক পণ্য এবং সময়ের ধারাবাহিকতায় প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিপণনযোগ্য হবে এরূপ কোনো পণ্য বা সেবা বিপণন করা যাবে না। অথচ সেই একই পদ্ধতিতে এই ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে।’ নীতিমালার ১৭নং ধারায় রয়েছে নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত মূল্য নেয়া যাবে না। ১৮নং ধারায় অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ না করার কথা বলা হয়েছে। ১৯নং ধারায় নিম্নমানের পণ্য বিপণন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২১নং ধারায় পণ্য ও সেবার বাস্তব উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে। তবে এ ধরনের কোনো নির্দেশনাই মানছে না প্রতিষ্ঠানগুলি। ২০১৫ সালে জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, দেশে কোনো এমএলএম কোম্পানিকে সরকার লাইসেন্স দেয়নি।
খুলনা জেলা সমবায় অফিসে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, ওই সব এমএলএম প্রতিষ্ঠিান বিভিন্ন সময়ে আমাদের অনুমোদন আছে বললেও প্রকৃতপক্ষে তারা আমাদের নিয়ন্ত্রনভুক্ত নয়, আমরা কোনো অনুমোদনও দেইনা।
এমএলএম কোম্পানিগুলো শহরে নতুনভাবে ফাঁদ পাতলেও তাদের সম্পর্কে ধারণা নেই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান খুলনা রেজিষ্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির।
সরেজমিনে অফিসে গেলে রেজিষ্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির হিসাব পরীক্ষক মোঃ ফজলুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন এমএল এম কোম্পানিগুলো সম্পর্কে আমাদের কোন ধারনা নেই। তারা কিভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে তাও আমাদের ধারণার বাইরে।