ডেস্ক রিপোর্ট : এক শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করতে এসেছেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭১ সালের কথা। বাংলাদেশে চলছে স্বাধীনতাযুদ্ধ। প্রায় এক কোটি লোক জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। বড় রকমের একটা চাপ পড়েছে ভারতের অর্থনীতিতে। তবু তারা আশ্রয় দিয়েছে মানুষগুলোকে। পাকিস্তানি বর্বরদের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে বাঙালিকে। ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর গভীর মমত্বের দৃষ্টি। সেই শরণার্থীশিবির ঘুরে ঘুরে দেখছেন তিনি। নিরাপত্তাকর্মীরা আগলে রেখেছেন তাঁকে। এই নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে শরণার্থীশিবিরের এক বৃদ্ধা কেমন কেমন করে পৌঁছে গেলেন ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। বিনীতভাবে তাঁকে বললেন, ‘মা, আপনি আমাদের বাঁচান।’
মহীয়সী ইন্দিরা গভীর মমতায় হাত রাখলেন সেই বৃদ্ধার কাঁধে। বললেন, ‘চিন্তা করবেন না। আপনারা আমাদের অতিথি। ভারতীয়দের কাছে অতিথি হচ্ছেন দেবতা।’ভারত দেশটিকে এক কোটি অতিরিক্ত মানুষের চাপের মধ্যে রেখেই ইন্দিরা গান্ধী ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি দিলেন। বাংলাদেশে তখন যে বর্বর হত্যাকাণ্ড আর মানবিক বিপর্যয় ঘটছিল, সে ব্যাপারে নৈতিক সমর্থন আদায় করাই তাঁর উদ্দেশ্য। বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া ও ব্রিটেন হয়ে তিনি গেলেন আমেরিকায়। ইউরোপের দেশগুলো আদর-আপ্যায়ন ঠিকই করল, বাংলাদেশি শরণার্থীদের সম্পর্কে মৌখিক সহানুভূতি জানাল, আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিল, কিন্তু আসল সমস্যাটি এড়িয়ে গেল আমেরিকার কারণে। ভাবটা এ রকম যে তুমি তো আমেরিকায় যাচ্ছই, সেখানেই সব শুনবে।একাত্তরে আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারত, ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। একদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান, আর অন্যদিকে ভারতের অবদান, ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা—সব মিলিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ
ওয়াশিংটন ডিসিতে আসার পর প্রেসিডেন্ট নিক্সন খাদ্য, স্বাস্থ্য, আবহাওয়া ইত্যাদি নিয়ে হালকা মেজাজে কথা চালিয়ে গেলেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। আসল কথা তুললেনই না। ইন্দিরা একসময় সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘পাকিস্তান সরকার সে দেশের পূর্বাঞ্চলে যে অত্যাচার চালাচ্ছে, সে বিষয়ে আপনি কি কিছু ভেবেছেন?’ নিক্সন সাহেব বললেন, ‘ভেবেছি। ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে যদি কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়, তাতে কি আমাদের নাক গলানো ঠিক হবে?’ ইন্দিরা বললেন, “সমস্যা ভারত-পাকিস্তানের নয়, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ। পূর্ব পাকিস্তানে নৃশংস গণহত্যা চলছে। আপনার দেশের সাংবাদিক অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাস এ বিষয়ে বই লিখেছেন। বইয়ের নাম ‘দ্য রেপ অব বাংলাদেশ’। এই বইয়ে জেনারেল ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে হিটলারের নািস বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনাদের উদ্যোগ নেওয়া উচিত, শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আপনারাই চাপ দিতে পারেন।”
এ ব্যাপারে নিক্সন সাহেব ইন্দিরা গান্ধীকে কোনো প্রতিশ্রুতিই দিলেন না। শরণার্থীদের জন্য সাহায্য বাড়িয়ে দেবেন বললেন। ইন্দিরা গান্ধী বললেন, ‘আমি আপনার কাছে ভিক্ষার পাত্র নিয়ে আসিনি। আমি চাইছি সমস্যাটির সমাধান। একদিকে আপনারা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য পাঠানোর কথা বলছেন, আর অন্যদিকে পাকিস্তানি বর্বর সেনাদের হাতে আরো অস্ত্র তুলে দেবেন—এ কেমন নীতি?’আমেরিকার মিডিয়ায় জোরালোভাবে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দিলেন ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী। সে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেল তাঁর বক্তব্য। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তব্যেও একই সুর তাঁর। আমেরিকা থেকে প্যারিসে গেলেন। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জর্জ পঁপিদু ইন্দিরার বাবা নেহরুর বন্ধু। ইন্দিরা সুইজারল্যান্ডে থাকার সময় ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন। তাঁর কোনো দোভাষী লাগল না। পঁপিদুর সঙ্গে ফরাসি ভাষায়ই কথা বলে গেলেন। পঁপিদুও তাঁকে বাংলাদেশের ব্যাপারে তেমন কোনো আশ্বাস দিতে পারলেন না। কারণ মাথার ওপরে আছে আমেরিকা।
২০ দিন পর দেশে ফিরে এলেন ইন্দিরা গান্ধী। তখন তাঁর বয়স ৫৪ বছর।কলকাতায় এলেন জনসভা করতে। পশ্চিমবঙ্গ তখন টালমাটাল করে রেখেছে নকশালীরা। চারু মজুমদার পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কলকাতার জনসভায়ও বাংলাদেশ সমস্যার কোনো স্পষ্ট সমাধানের ইঙ্গিত দিতে পারলেন না ইন্দিরা গান্ধী। যুদ্ধের কোনো উল্লেখ না করে দেশের মানুষকে আরো আত্মত্যাগী হতে বললেন।তারপর রাজভবনে এলেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে, চিত্রতারকাদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনা করতে। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কেউ তখন ভাবছে না। কথায় কথায় যুদ্ধের প্রসঙ্গ এসে গেল। পাকিস্তানিরা ভারতের কোনো কোনো সীমান্তে হানা দিচ্ছে। পুরোপুরি যুদ্ধ কি লেগে যাবে?ইন্দিরা গান্ধী বললেন, এখন সবচেয়ে বড় কাজ মাথা ঠাণ্ডা রাখা। এ সময় লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা, ভারতীয় আর্মির ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান এসে একটা চিরকুট দিলেন ইন্দিরা গান্ধীর হাতে। তিনি কয়েক মিনিট চিরকুটটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কাগজটা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। একদমই নির্বিকার ভঙ্গি। নায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে কী কথা বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলেন, সেই কথা শেষ করে সবাইকে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। দমদম থেকে এয়ার ফোর্সের প্লেনে দিল্লি। এই ঘটনার কিছুক্ষণ পরই ভারতের রাষ্ট্রপতি সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করলেন। মধ্যরাতে বেতার ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে ভারত-পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।
এই সব ঘটনা আমরা যাঁরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি তাদের মনে আছে। একাত্তরে আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারত, ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। একদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান, আর অন্যদিকে ভারতের অবদান, ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা—সব মিলিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ।ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের ছায়া অবলম্বনে মুম্বাইয়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক গুলজার একটি ছবি নির্মাণ করেছিলেন। ছবির নাম ‘আঁধি’। ইন্দিরা গান্ধীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বাংলার কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন। নায়ক ছিলেন সঞ্জীব কুমার। লতা মুঙ্গেশকর আর কিশোর কুমারের অসামান্য কিছু গান ছিল। সংগীত পরিচালক শচীন দেব বর্মন।ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনি প্রচলিত আছে। তিনি ছিলেন গভীরভাবে শিল্পানুরাগী মানুষ। কিছুকাল শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছেন। গুণী শিল্পী-সাহিত্যিকদের কদর করতেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ধ্রুপদি পরিচালক ঋত্বিক ঘটক মুম্বাই গিয়ে এক হোটেলে আছেন। দিনের পর দিন থাকছেন, খাচ্ছেন। বিদায়ের দিন বিল দিতে পারছেন না। তাঁর কাছে টাকা নেই। হোটেল ম্যানেজারকে বললেন, ‘ইন্দিরা গান্ধীকে ফোন করো।’ ম্যানেজার ভাবলেন, লোকটা পাগল। কিন্তু ঋত্বিকের ওই একই কথা, ‘ফোন করে আমার কথা বলো, হোটেল বিল পরিশোধ করতে বলো।’ ম্যানেজার মহা বিরক্ত। তার পরও কেমন কেমন করে ইন্দিরা গান্ধীর পিএসের ফোন নম্বর জোগাড় করলেন, ঘটনা বললেন। ইন্দিরা গান্ধীর কানে গেল কথাটা। ঋত্বিক ঘটক নামটা শুনে তিনি একমুহূর্তও ভাবলেন না। বললেন, ‘উসকো তাং মাত কারো। রুপিয়া দে দো।’ (ওঁকে বিরক্ত কোরো না। টাকা দিয়ে দাও)।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলেন। গল্পের নাম ‘নদীতীরে’। এই গল্পে প্রহরীকে আততায়ী মনে করে তার নিরাপত্তা নিয়ে নায়কের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর চমৎকার চমৎকার সংলাপ ছিল। গল্পটি সংলাপনির্ভরই। বর্ণনা ছিল খুব কম। তবে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার মতো। আশ্চর্য ব্যাপার, ইন্দিরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই গল্পের থিম অনেকটা মিলে যায়। প্রহরীই আততায়ী হয়ে ওঠে। খুনি হয়ে ওঠে। প্রহরীর গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী।‘ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি’—এই নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন সুনীল। তাঁর খুব প্রিয় চরিত্র ছিলেন শ্রীমতী গান্ধী। কবিতার কয়েকটি লাইন এ রকম :‘প্রিয় ইন্দিরা, তুমি বিমানের জানালায় বসে গুজরাটের বন্যা দেখতে যেও না।এ বড় ভয়ংকর খেলা।ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতে পারে, ‘বাঃ কী সুন্দর!’কে একজন ইংরেজিতে এই কবিতা অনুবাদ করে ইন্দিরা গান্ধীকে শোনালেন। শুনে তিনি তাঁর পৃথিবীখ্যাত হাসিটি হাসলেন। সুনীলের উদ্দেশে বললেন, ‘নটি বয়।’প্রিয় ইন্দিরা গান্ধী, আপনার স্মৃতির উদ্দেশে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনাকে কখনোই ভুলবে না বাংলাদেশ। আপনার অবদান মনে রাখবে।