আওয়াল শেখ, Prabartan | আপডেট: ০৮:৩১, ৩১-০৩-১৯
‘ভোট দিতে পেরে আমি খুশি। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আজ ভোট দিব। ভোট না দেওয়ার জন্য প্রতিদিনের মতন আজ সকালেও কলার ভ্যান নিয়ে বের হয়েছিলাম। বাজারে যাচ্ছিলাম কলা বিক্রি করতে। মাঝ পথ থেকে ফিরে এসেছি। সকালে ছোট মেয়েটা এসেছিল ভোট কেন্দ্রে। সে আমাকে ফোন করে বলল বাবা তুমি ভোট দিতে আসো। এখানে সবাই সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট দিচ্ছি। তাই ফিরে আসলাম। আমার ভোট আমি দিতে পেরে নির্বানের স্বাদ পাইছি (পেয়েছি)। অ্যান্নে (এখন) বাড়ি যাব মেয়ের মাকে কেন্দ্রে আনতে। সে তো মোটে ভোট দিতি (দিতে) চাইলনা (চায়নি)। আমি তাড়াতাড়ি যাই তাকে নিয়ে আসি যাতে নিজির (নিজের) ভোটটা দিয়ে শান্তি পায়’। খুলনার তেরখাদা উপজেলার ২০ নং কুমিরডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর এ অনুভূতি ব্যক্ত করেন হাড়িখালী গ্রাম থেকে ভোট দিতে আসা মইনুল ইসলাম (৪৫)।
রোববার (৩১ মার্চ) সকাল ৮টা থেকে খুলনার ৮টি উপজেলা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়। কিন্তু ভোট গ্রহণের প্রথম প্রহরে খুলনার বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের তেমন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। বিশেষ করে তেরখাদার ২০ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আজগরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোদলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বারাসাত হাইস্কুল, রূপসার নবীনগর ইসলামিক মিশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ইলাইপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কেন্দ্র ছিল প্রায় ভোটার শূন্য। গল্পগুজব করে অলস সময় পার করছিলেন ভোট কেন্দ্রে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
তবে বেলা বাড়ার সাথে সাথে দেখা যায় ভিন্ন রূপ। হালকা রৌদ্রময় মাঠে দীর্ঘ লাইনের এসে দাড়াতে থাকে একের পরে এক ভোটাররা। জনোস্রোতে সঞ্চলতা ফিরে পায় ভোট কেন্দ্রে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে নির্বাচনী কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্টসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভোট নিয়ে তাদের আগ্রহ ছিল না। এই দিনে কেমন পরিস্থিতি থাকবে? পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে কিনা? ভোট দিতে গিয়ে কোন হামলা মালমার শিকার হবে কিনা এমন নানা ভাবনায় ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অনেকে। কিন্তু ভোটের দিনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় তারা পূর্বের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসে। পরিবার পরিজন নিয়ে ভোট কেন্দ্রে এসে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
সরকারি আজগরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে আসা কলেজ শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম বলেন, আমি খুলনায় সরকারি বিএল কলেজে পড়ি। ভোট নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। যদিও আমার জীবনে এটা প্রথম উপজেলা নির্বাচন পেয়েছে। প্রথম বার নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারব কিনা তা ভেবে ভোট না দেওয়ার সিদ্ধন্ত বাদ দিয়। তাই ভোটের দিনে খুলনায় ছিলাম। গ্রামের বাড়িতে আসিনি। মা সকালে ভোট দিতে এসেছিল। মা জানায় ভোটের পরিবেশটা সুন্দর আছে। সকলে সুস্ঠুভাবে ভোট দিতে পারছে। তাই আমি খুলনা থেকে ছুটে এসেছি। বাড়ি থেকে চটজলদি ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে কেন্দ্রে এসেছি। আমি আমার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছি। জিবনের প্রথম উপজেলা নির্বাচনে ভোট টা আমার স্বার্থক হয়েছে।
আজগরার আরেক কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা ষাটোর্ধ্ব মোসলেম আলী জানান, “আমি সকালে কেন্দ্রে আসি। তবে সকালে ভোট দেই নাই। তখন কেউ তেমন একটা ছিলনা। তাই আমিও ভোট কেন্দ্রে ঢুকছি না। ঘুরে ফিরে দেখছি সকলে কি করে। এখন অনেকে আইছে তাদের সাথে লাইনে দাঁড়াইছি। সবাই মিলে ভোট না দিলি কি মনে সারে। দ্যাহেন এখন কত বড় লাইনে দাড়াইছি, সবাই মিলে ভোট দিব”।
তেরখাদার ২০ নং কুমিরডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিজাইডিং অফিসার প্রবর্তনকে বলেন, তেরখাদা উপজেলা নির্বাচনে বড় ভোট কেন্দ্রের মধ্যে এটি অন্যতম। সকাল থেকে সুষ্ঠুভাবে এই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ চলছে। কোন প্রকার আপত্তিকর ঘটনা ঘটনি। পুলিশ ও আনসার সদস্যরা অত্যান্ত সক্রিয় ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। মাঝে মাঝে ম্যাজিস্ট্রটরা আসছেন। বিজিবির টহল আছে। সাংবাদিকরা এসে পোলিং এজেন্টদের সাথে আলাপ করছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তার জন্য কোন দলের লোকজন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারছে না। আশা করি এখানে অত্যান্ত শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হবে।
নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় কঠোর অবস্থান রয়েছেন তারা। ইতোপূর্বে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্পর্শকাতর এলাকা ও দূরবর্তী স্থান বিবেচনায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে খুলনার ৬৫ শতাংশ কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। কঠোর নিরাপত্তার চাদর বিছিয়ে দেওয়ার জন্য, খুলনার ৮ উপজেলায় ২১ হাজার পুলিশ, ৪ হাজার ৬৯২ আনসার, ২৪ প্লাটুন বিজিবি, র্যাবের ১৮টি পেট্রোল টিম ও ২০৭ জন কোস্টগার্ড দায়িত্বে রাখা হয়েছে। এছাড়াও খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) আওতায় ৪৬টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ৩১টি কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৫টি কেন্দ্র সাধারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেখানেও কঠোর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
উল্লেখ্য, রোববার (৩১ মার্চ) পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের চতুর্থ ধাপে খুলনা জেলার ৯ উপজেলার ৮টিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৭ মার্চ নৌকা প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে দ্বন্দ্বে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাচন ১০ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। যার কারণে রোববার ডুমুরিয়া উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ২১ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪০ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩৫ জন প্রার্থী ভোট যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ১০৬৭৩৮৪ জন যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫৩৪১১৩ জন ও মহিলা ভোটার ৫৩৩২৭১ জন।