চিকিৎসক না প্রতারক?

নিজস্ব প্রতিবেদক, prabartan | প্রকাশিত: ২০:০৪, ১০- ০৩-১৯

চেম্বারে রোগী ঢুকলেই তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে বসানো হয় একটি ল্যাপটপের সামনে। ল্যাপটপের ওয়েব ক্যামেরায় রোগীর অজান্তে ছবি তুলে রাখা হয়। এর পর একটি মানব দেহের ছবি বের করে সেটি রোগীর ছবির পাশে বসিয়ে জানতে চাওয়া হয় সমস্যার কথা। প্রথমেই জানতে চাওয়া হয় জন্ম তারিখ। গ্রাম্য সহজ সরল মানুষেরা জাকজমকপূর্ণ ডাক্তারের চেম্বারে বসে অধিকাংশই বলতে পারেন না। তখনই প্রেসক্রিপসনের এক পাশে আঁকা মানবদেহের ছবির মাথায় কলম দিয়ে একটি ফোটা দেওয়া হয়। রোগীকে বলা হয় আপনার স্মরণশক্তি একেবারেই নেই। এরপর বিভিন্ন প্রসংগ টেনে আনেন।

  • ল্যাপটপে রোগীর ছবি নিয়ে রোগ নির্নয়
  • লাঠি হাতে ধরিয়ে সর্ব রোগের পরীক্ষা ও চিকিৎসা
  • প্রেসক্রিপসানে লেখা ওষুধ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না

অভিনব পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়ার নাম করে অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন মিজানুর রহমান নামে এক ব্যাক্তি। নিজেকে তিনি অভিজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালি বাজারের মাসুম মার্কেটে তার একটি চেম্বার রয়েছে। সেখানে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত তিনি রোগী দেখেন। তার প্রেসক্রিপসানে ‘ডিএমএ মেডিসিন, আকুলাইফ অভিজ্ঞ’ লেখা রয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) রামপালের পেড়িখালি গ্রাম থেকে শ্বাস কষ্টের চিকিৎসা নিতে আসেন খুকু মনি (৪৫)। তাকে প্রথমে ল্যাপটপের সামনে বসিয়ে একটি প্লাস্টিকের লাঠি হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর পদ্ধতিগতভাবে তার জন্ম তারিখ জানতে চাওয়া হয়। বলতে না পারায় ডাক্তার মিজান তাকে বলেন, ‘কেবল চোখ বন্ধ করে নৌকায় ভোট দিলে হবেনা, জন্ম তারিখ মনে রাখা লাগবে। আপনার মাথায় সমস্যা আছে।’ পরে প্রেসক্রিপসানে আঁকা মানবদেহের ছবির মাথায় ফোটা দেওয়া হয়। বলা হয় রোগীর স্মরণ শক্তি নেই। কিডনিতে ফোটা দিয়ে বলা হয় আপনার কিডনির সমস্যা আছে। পেটে ফোটা দিয়ে বলা হয় গ্যাসের সমস্যা দীর্ঘ দিনের। এমনকি হার্টের সমস্যার কথাও বলা হয়। এরপর দ্রুত প্রেসক্রিপসান লিখে নিজের চেম্বার থেকে ওষুধ দিয়ে দেন। চিকিৎসকের নির্ধারিত ফি ৫ শ এবং ওষুধ মিলিয়ে তার কাছ থেকে ২ হাজার টাকা নেওয়া হয়।

রোগীকে ল্যাপটব দেখিয়ে বিভিন্ন পরিক্ষার ফলাফল অনুসারে প্রেসক্রিপসনের একপাশে মানবদেহের ছবিতে চিহ্ন দেয়া হয়।

রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামের শরীফা বেগম নামে এক শ্রমজীবি নারী অভিযোগ করেন, বাতের ব্যাথার চিকিৎসা বাবদ গত চার মাসে তার কাছ থেকে ৮ হাজার টাকা নিয়েছেন চিকিৎসক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ডাক্তার আমাকে কম্পিউটার দেখিয়ে বলেন প্রতি মাসে তোমাকে একবার এখানে আসতে হবে। কম্পিউটার কখনও মিথ্যা বলে না।’

স্থানীয়রা জানান, এক সময় এলাকায় ঘোরাফেরা করে, আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে দেখা যেত মিজানুর রহমানকে। হঠাৎ করে ইউনানী চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন তিনি। বর্তমানে জাকজমকপূর্ণ একটি চেম্বার ভাড়া করে সেখানে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন। প্রতিদিন দুর দুরান্তের গ্রাম থেকে রোগী আসছেন। তবে মহিলা রোগীর সংখ্যা বেশি বলে স্থানীয়রা জানান। প্রত্যহ ৪ ঘন্টায় তিনি ৩০ থেকে ৫০ জন রোগীর চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।

কাটাখালি বাজারের এক ফল বিক্রেতা বলেন, আমাদের এলাকার কেউ তার কাছে চিকিৎসা নিতে যায় না। দুরের গ্রাম থেকে বিভিন্ন বয়সী মহিলারা চিকিৎসা নিতে আসেন। এক সময় খুব বেশি রোগী হতো না, এখন কম্পিউটারে চিকিৎসা দেওয়ায় অনেক রোগী আসতে দেখা যায়।

তার কাছে চিকিৎসা নেওয়া কয়েকজন নারীর সাথে কথা হলে তারা জানিয়েছেন, যে কয়েকদিন ওষুধ চলে একটু ভাল হয়। ওষুধ শেষ হলে একই সমস্যা আবার দেখা দেয়। তখন আবারও ছুটতে হয় ডাক্তারের কাছে। তবে তার কাছে চিকিৎসা নিয়ে কারো রোগ সেরেছে এমন কাউকে পাওয়া যায়নি।

কথিত চিকিৎসক মিজানুর রহমানের সাথে ফোনালাপ

জানতে চাইলে চিকিৎসক মিজানুর রহমান বলেন, আমি হেকিমি শাস্ত্র মতে রোগীদের ওষুধ দিয়ে থাকি। এ ব্যাপারে তার প্রাতিষ্ঠানিক কোন সনদ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোন কথা বলেননি।

কম্পিউটারে কিভাবে রোগ নির্ণয় করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কম্পিউটার নয়, আমি আকুপাংচার মেশিনের সাহায্যে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তবে আকুপাংচার পদ্ধতি কি সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানাতে পারেননি। এক পর্যায়ে তিনি এ প্রতিবেদককে তার চেম্বারে চা খাওয়ার দাওয়াত দেন।

ফকিরাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অসীম সমাদ্দার বলেন, এভাবে চিকিৎসা দেওয়া এক ধরনের প্রতারণা। তদন্ত করে দেখে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top